বাড়ির মাঝে উঠোন। উঠোনের মাঝে তুলসী মঞ্চ। মঞ্চে শোভা পায় তুলসী গাছ। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতে জল দিতে কোনওদিন ভুল হয় না। গৃহদেবতার নৈবেদ্যর থালায় তুলসী চাই-ই-চাই। তুলসী আসলে ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। তাই যে বাড়িতে উঠোন নেই সেই বাড়িতেও ছাদ কিংবা বারান্দায় ছোট্ট টবে বেড়ে ওঠে তুলসী। তুলসী যেন পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সুখ-দুখ জুড়ে থাকে। তুলসী পবিত্রতা আর নিষ্ঠার প্রতীক।
তুলসী আর শালগ্রাম শিলা নাহলে সম্পন্ন হয় না নারায়ণের আরাধনা। কার্তিক মাস পড়লেই দেশ মেতে ওঠে তুলসী বিবাহ উৎসবে।কার্তিকের একাদশী তিথিতে উদযাপিত হয় তুলসী বিবাহ। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে ভগবান বিষ্ণু তুলসীকে বিবাহ করেছিলেন। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের কাছে এই দিনটি বিশেষ। তারা পরের দিন তুলসী বিবাহ উদযাপন করে।
এদেশে বিয়ের মরসুম শুরু হয় তুলসী বিবাহ দিবস দিয়ে। হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী বিবাহ এবং অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠান চাতুর্মাস মানে চৈত্র, ভাদ্র, আশ্বিন এবং কার্তিক-এই চার মাসে অনুষ্ঠিত হয় না। একাদশী তিথিতে তুলসী বিবাহের মাধ্যমে চাতুর্মাস শেষ হয় এবং শুভ অনুষ্ঠানের মরসুম শুরু হয়।
কথিত আছে, ভগবান বিষ্ণু, যিনি চার মাস ধরে সাগরের তলদেশে নিদ্রায় আসীন ছিলেন। কার্তিক মাসের শুক্ল একাদশী তিথিতে তিনি তুলসীকে বিয়ে করেছিলেন। এই দিনটিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ তুলসী এবং ভগবান কৃষ্ণের বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করে।
তুলসী বিবাহের দিনে তুলসী গাছকে নববধূ এবং শালগ্রাম শিলাকে বর বেশে সাজানো হয়। এই উৎসবে হিন্দু বিবাহের সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে। বলা হয় তুলসী বিবাহ উদযাপন করলে ভাগ্য প্রসন্ন হয়। শুভ সময় শুরু হয় জীবনে। লোক বিশ্বাস তুলসী বিবাহ দিলে কন্যাদানের পুণ্য অর্জিত হয়। বিবাহ সংক্রান্ত জটিলতাও কেটে যায়।
তুলসী বিবাহের চল খুব প্রাচীন। পদ্মপুরাণে তুলসী বিবাহের উল্লেখ মেলে।
হিন্দু পুরাণে তুলসী এবং শালগ্রামের একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। সেই কাহিনি অনুযায়ী, রাক্ষস কুলে এক কন্যার জন্ম হয়। নাম তার বৃন্দা। অসুর কুলে জন্ম হলেও ছোটবেলা থেকেই সেই কন্যা অত্যন্ত ভক্তিমতী। ভগবান বিষ্ণু তার আরাধ্য। সারাদিন তাঁর আরাধনাতেই মগ্ন থাকত সে।
বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠলে জলন্ধর নামে এক রাক্ষসের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয় বৃন্দার। বিষ্ণুর আরাধনা ও পতিব্রতা হওয়ার কারণে বৃন্দার স্বামী জলন্ধর অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে ওঠে। বলা যায়, প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তার আস্ফালন আতঙ্ক ছড়ায় দেব-দেবীদের মধ্যে।
স্বামীর কল্যাণে বৃন্দার সাধনায় জলন্ধর সব যুদ্ধে অপরাজিত থেকে যায়। এক সময় দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সে। ত্রস্ত দেবতারা তখন বিষ্ণুর শরনাপন্ন হন। বিষ্ণু তাঁদের আশ্বাস দেন জলন্ধরকে প্রতিরোধ করবেন তিনি।
জলন্ধরকে পরাস্ত করতে এক কৌশল ঠিক করেন বিষ্ণু। তিনি জলন্ধরের রূপ ধারণ করে বৃন্দার কাছে আসেন। বৃন্দা বিষ্ণুকে স্বামী জলন্ধর ভেবে বিভ্রান্ত হন। এই ঘটনায় জলন্ধরের তেজ যায় কমে। যুদ্ধে পরাস্ত হয় সে। যুদ্ধেক্ষেত্রেই তার মৃত্যু হয়। এদিকে বিষ্ণুর ছলনার কথা জেনে যান বৃন্দা। ভীষণ রেগে যান তিনি।
বিষ্ণুকে শিলা অর্থাৎ পাথরে রূপান্তরিত হওয়ার অভিশাপ দেন। তাঁকে পাথরে পরিবর্তিত হতে দেখে দেবতারা ভীত হয়ে পড়েন। শেষপর্যন্ত দেবী লক্ষ্মীর প্রার্থনায় বৃন্দা নিজের অভিশাপ ফিরিয়ে নেন। তিনি জলন্ধরের সঙ্গে সহমরণে যান। অন্য একটি মত বলে বৃন্দা সাগরে নিমজ্জিতা হন।
কথিত আছে, বৃন্দার শরীরের ভস্ম থেকে একটি ছোট্ট চারার জন্ম হয়। বিষ্ণু সেই চারার নাম দেন ‘তুলসী’। বিষ্ণু তাঁকে পরজন্মে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শালগ্রাম রূপে তুলসীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।
তিনি বর দেন প্রতিটি গৃহে পূজিতা হবেন তুলসী। তুলসী ছাড়া তাই আজও নারায়ণের পুজো অসম্পূর্ণ।