অভিমানে সিনেমার জগৎ ছেড়ে গ্রামে গিয়ে চাষবাস শুরু করেছিলেন শিল্পী তুলসী লাহিড়ী

জমিদার বাড়ির সন্তান তুলসী লাহিড়ী। রংপুরের নলডাঙার বিখ্যাত জমিদার সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী তাঁর বাবা। জমিদার হলেও বেশ শিল্পরসিক মানুষ ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ। ভালো গান গাইতে পারতেন, ছিল সঙ্গীতশাস্ত্রে অসামান্য দখল। তাঁর কাছেই বাল্যকালে হয়েছিল সঙ্গীতে তুলসীর হাতেখড়ি। তারপর বাবা-ই তাঁকে একদিন বিখ্যাত ওস্তাদ খেলাফত হোসেন সাহেবের কাছে তালিম নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তাছাড়া জমিদার বাড়িতে নিয়মিত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসত, আসতেন বড় বড় সব গাইয়ে-ওস্তাদ। ফলে তাঁদের দেখে, তাঁদের গান শুনে, যোগ্য গুরুর কাছে তালিম পেয়ে অতি অল্প বয়সেই সঙ্গীতকে আত্মস্থ করেন তুলসী।

বাড়িতে বাবা যে শুধু গানের আসর বসাতেন তাই নয়, বসাতেন অভিনয়ের আসরও। স্থানীয় নাট্যদল, পালারদলকে খুব উৎসাহ দিতেন। সেই আসরের অভিনয় দেখতে দেখতে সঙ্গীতের পাশাপাশি অভিনয়কেও দারুণ ভালোবেসে ফেলেন তুলসী। বাবা জানতে পেরে রংপুরের এক নাট্যদলের প্রখ্যাত অভিনয়-শিক্ষক তারাপ্রসন্ন সান্যালের কাছে অভিনয় শেখার ব্যবস্থা করে দেন।

সঙ্গীত ও শৌখিন দলে অভিনয় চর্চা করতে করতেই রংপুর-কলকাতা যাতায়াতের মাঝখানে রিপন অর্থাৎ এখনকার সুরেন্দ্র কলেজ থেকে ল’ পাশ করে ফেলেন তুলসী। বাবা জীবনে তাঁর অনেক ইচ্ছে পূর্ণ করেছেন, এক্ষেত্রে তুলসী বাবার ইচ্ছে পূর্ণ করেন।

এরপরই আলিপুর কোর্টে প্র্যাকটিসের জন্য পুরোপুরি কলকাতায় চলে আসেন তিনি। কথায় বলে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, তাঁর ক্ষেত্রেও সেটাই দেখা গেল। ওকালতি মাথায় রেখে চলতে লাগল কালোয়াতির আসরে আসরে তাঁর এনতার ছোটাছুটি, গান গাওয়া আর গান লেখা। এমনি করেই একদিন যোগাযোগ ঘটে গেল এইচ এম ভি'র সঙ্গে।

এই এইচ এম ভি' থেকেই বছর খানেকের মধ্যে তাঁর লেখা দুটি গান রেকর্ড করলেন ওস্তাদ জমীরুদ্দিন খাঁ-সাহেব। গান দুটো এতই জনপ্রিয় হল যে, এইচ এম ভি' তুলসীকে একেবারে কোম্পানির গীতকার ও সঙ্গীত পরিচালক করে নিল। এটা ১৯৩০ সালের ঘটনা। এই সময় তাঁর লেখা ও সুরে রেকর্ড করে কমলা ঝরিয়া, আব্বাসউদ্দীন, জ্ঞান গোস্বামীর মতো পরবর্তীকালের স্বনামধন্য শিল্পীরা উঠে এলেন, বিখ্যাত হলেন।

রেকর্ড শুনে সঙ্গীতে তুলসীর অভূতপূর্ব দখল দেখে খুঁজেপেতে তাঁকে দলে ডেকে নিলেন প্রখ্যাত নট ও অভিনয়-শিক্ষক অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। অপরেশের দলের নাম, আর্ট থিয়েটার্স লিমিটেড। তখন ওঁরা স্টার ভাড়া নিয়ে থিয়েটার করছিলেন। এই দলে সুরকার হিসেবে যোগ দিয়ে তুলসী যেন হাতে চাঁদ পেলেন। তাঁর শৈশবের ভালোবাসাকে কাছে পাওয়ার আনন্দ পেলেন যেন। অভিনয়ের জন্য অধীর হলেন। অপরেশ তাঁর বুঝলেন। তাই 'স্বয়ম্বরা', 'পোষ্যপুত্র', 'মন্দির'--এই তিনটি নাটকে সুরকার হিসেবে কাজ করিয়ে নেওয়ার পর পরই চতুর্থটিতে দিলেন তুলসীর বহু আকাঙ্ক্ষিত অভিনয়ের সুযোগ। সেই নাটকের নাম, 'চিরকুমার সভা'। এই নাটকে চন্দ্রের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয়ে একেবারে মাতিয়ে দিলেন তুলসী। হয়ে গেলেন নাটকের নিয়মিত অভিনেতা।

সেই সময় নাটকের দল থেকেই অভিনেতা সংগ্রহ করতেন চিত্রপরিচালকেরা। পরিচালক হীরেন বসুর অত্যন্ত ভালো লেগেছিল তুলসীর অভিনয়। তাই তাঁর নির্বাক ছবি 'চুপ' নির্মাণের সময় অভিনেতা হিসেবে তুলসীকে ডেকে নিলেন। এবার চলচ্চিত্রেও তাঁর অভিষেক হয়ে গেল। হয়ে গেলেন সেখানকারও নিয়মিত অভিনেতা। সারাজীবন ধরে প্রায় পঞ্চাশের বেশি ছবিতে তিনি অভিনয় করলেন। তাঁর শেষতম ছবিটি তপন সিনহার 'ক্ষণিকের অতিথি'।

চলচ্চিত্র জগতে এই যে তিনি প্রবেশ করলেন, এতে শুধুমাত্র অভিনেতার ভূমিকাতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেন না। তাঁর মতো বহুমুখী প্রতিভাবান মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভবও ছিল না। তাঁর প্রতিভাকে যাঁরা চিনেছিলেন, তাঁরাই তাঁকে ডেকে নিয়েছিলেন এই শিল্পলোকের ভিন্ন ভিন্ন দপ্তরে। এভাবেই তুলসী বিভিন্ন প্রযোজনাসংস্থার হয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলা সিনেমার কাহিনিকার হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর লেখা কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত প্রথম ছবি, 'যমুনাপুলিনে' (১৯৩০)। তারপর একে একে 'মনিকাঞ্চন', 'কেরানীর জীবন', 'মায়াকাজল', 'বেজায় রগড়' প্রভৃতি কমেডি ছবির জন্যও তিনি কাহিনি রচনা করেছেন। অন্যের জন্য কাহিনি লেখার মাঝে 'কালী ফিল্মস' নামের প্রযোজনা সংস্থার হয়ে ছায়াছবিতে সুরকার হিসেবেও কাজ করেছেন। আত্মপ্রকাশ করেছেন চলচ্চিত্র পরিচালকরূপেও। তাঁর পরিচালিত ছবিগুলোর মধ্যে 'বিজয়িনী', 'চোরাবালি' সমসময়ে খুব বিখ্যাত হয়েছিল।

সিনেমার বহু বিচিত্র দিকের সঙ্গে এভাবে সম্পৃক্ত থেকেও ১৯৪৫-৪৬ সাল নাগাদ আদর্শগত সংঘাতের ফলে অভিমানে সিনেমা-নাট্যজগৎ-রেকর্ড কোম্পানি সব ছেড়েছুড়ে তুলসী চলে যান দেশের বাড়িতে।  কলকাতার শিল্পমহলের সঙ্গে ছিন্ন করেন সমস্ত যোগাযোগ। শুরু করেন চাষবাস। এই সুযোগে ঘনিষ্ঠতা হয় গ্রামের চাষিদের সঙ্গে। তাঁদের সাহচর্যে জানতে পারেন তাঁদের আত্মার কথা। অভাব-অভিযোগ-যন্ত্রণার কথা। হয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। ইচ্ছে হয় তাঁদের সেই দুঃখ-দুর্দশার কথা দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরার। সিনেমার প্রতি অভিমান বজায় থাকলেও, সতীর্থদের অনুরোধে ফিরে আসেন দ্বিতীয় প্রেম নাট্যজগতের কাছে। লেখকরূপে। হাতে তুলে নেন কলম। রচনা করেন, 'দুঃখীর ইমান' নাটক।

নাটকটি প্রথম অভিনয় করেন শিশিরকুমার। বাংলা নাটকে গ্রামীন নিরণ্ন কৃষকের যে যন্ত্রণা বিজন ভট্টাচার্য তাঁর 'নবান্ন' নাটকে ভাষারূপ দিয়েছিলেন, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তারই বিস্তার ঘটেছে 'দুঃখীর ইমান' নাটকে পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিকায়। বাস্তবধর্মী নাট্য প্রযোজনা ও সর্বহারাকে নায়ক করে তার ভাষায় শ্রেণির জীবন যন্ত্রণাকে বুকে ধরে সেদিন বাংলা নাট্যধারার যে পালাবদল ঘটেছিল,  তাতে তাঁর নাটক বিরাট বড় ভূমিকা রেখেছিল। এই ধারারই সার্থক ফসল 'ছেঁড়া তার', 'পথিক', 'এই যুগ', 'বাংলার মাটি' প্রভৃতি। গণনাট্য থেকে বেরিয়ে এসে শম্ভু মিত্র যখন নাটকের দল গড়লেন 'বহুরূপী' নামে, তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তুলসী লাহিড়ী। তাঁর লেখা 'পথিক' নাটক দিয়েই পথ চলা শুরু হয় 'বহুরূপী'র।

তুলসী লাহিড়ী একদিকে যেমন বহুমুখী প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন, তেমনই ছিলেন আদর্শের প্রতি একান্ত অনুগত এক আপোষহীন মানুষ। আদর্শের জন্য তিনি সব ছাড়তে পারতেন, কিন্তু কোনকিছুর জন্যই আদর্শ নয়। অনন্য সাধারণ এই শিল্পীর প্রয়াণ ঘটে, ১৯৫৯  সালের ২২ জুন...

ঋণ: 'সোনার দাগ'- গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ।

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...