খবরের কাগজের হেডলাইনে কোনওদিন তাঁর নাম দেখা যায়নি। অথচ তাঁর কাজ ছিল শব্দ নিয়ে।
৪৫ বছরের সঙ্গীত জীবনে ৬৫০ টি ছবিতে ৩৫০০ টি গান লিখেছেন। এমন কোনও উৎসব নেই, এমন কোনও আবেগ নেই, এমন কোনও অনুভূতি নেই যার চলন তিনি তাঁর সুরে বাঁধেননি।
ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারের জন্য ৪০ বার মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ‘আপনাপন’, ‘এক দুজে কে লিয়ে’, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’, ‘তাল’ এর সেরা গীতিকারের সম্মান পেয়েছিলেন।
হিন্দি সিনেমায় গীতিকাররা যদি স্টারের মর্যাদা পান তাহলে হিন্দি সিনেমার জগতে সুপারস্টার লিরিসিস্ট তিনি। আনন্দ বক্সী।
পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডিতে জন্ম ১৯৩০ সালে।
ছোট বেলা থেকে গান অন্ত প্রাণ । ডুবে থাকতেন গানে। চোখে স্বপ্ন গাইয়ে হবেন। প্লে ব্যাক করবেন হিন্দি ছবিতে। কিন্তু বাড়ির লোকের তীব্র আপত্তি। একদিন পালিয়ে গেলেন বাড়ি ছেড়ে। মাথায় ঘুরছে বোম্বাই এর ভাবনা। সিনেমার জগতে পা রাখবেন।
কিন্তু কিছু তো করতে হবে। নাহলে পেট চলবে কী করে! আনন্দ যোগ দিলেন সেনা বাহিনীতে। জীবনের প্রথম চাকরী রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভিতে। টেলিফোন অপারেটরের কাজ।
শুরু হল দেশ ভাগের অস্থিরতা। রাতারাতি রাওয়ালপিন্ডি থেকে ছিন্নমূল হয়ে ভারতে। পা রাখলেন নবাবের শহরে। লক্ষ্মৌ।
আবার চেষ্টা করলেন আনন্দ। কিন্তু এবারও মায়ানগরীতে বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না। সেই সময়ে আরো অনেক গীতিকারের ভিরে নতুন মুখের ওপর বাজি ধরতে পারল না কেউ। শাকিল, শৈলেন্দ্র, মাজরুহ, রাজা মেহেন্দি আলি খান এঁদের মত মানুষদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা তখন আনকোরা আনন্দের নেই।
কবি হতে চাওয়া সেনা সদস্যটি ফিরে গেলেন সেনাবাহিনীতেই।
কয়েক বার ঘুরেও গেলেন মুম্বই। স্টুডিও স্টুডিও-তে ঘোরাঘুরিও চলল। ১৯৫৬ তে চাকরী ছেড়ে মুম্বই।
পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাওয়ার লড়াইটা যখন চলছে, একদিন আলাপ হয়ে গেল অভিনেতা ভগবানের সঙ্গে। সেই সূত্রেই সুযোগ মিলল ব্রিজমোহনের ‘ভালা আদমি(১৯৫৮)’ চারটে গানের সুযোগ। কিন্তু সাড়া তেমন মিলল না।
নিজের চারপাশের জগৎকে সহজ শব্দে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা ছিল তাঁর। মানুষের সুখ, দুঃখ, বেদনার অনুভূতিগুলো বাঁধতে পারতেন শব্দে। রোদ, বৃষ্টি জলের মতো সে সব খুব স্বাভাবিক ভাবে আসত তাঁর। সব অনুভূতিকে সুরের মূর্ছনায়, ছন্দে, লয়ে ধরতে পারতেন।
চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। বোম্বাই অধুনা মুম্বই নগরীর অলিখিত নিয়ম প্রতিভাকে সম্মান করতে জানে এই শহর। আনন্দের সহজ ভাষা মন ছুঁয়ে গেল কারুর কারুর।
আনন্দ বক্সী ভীষণ সম্মান করতেন গীতিকার অনিল বিশ্বাসকে। কাজ করতে শুরু করলেন তাঁর সঙ্গে। অনিল বিশ্বাস এর ভরসা ছিল তাঁর ওপর।
১৯৬২ তে কল্যাণজি-আনন্দজির সুরে ‘মেহেন্দি লাগি মেরি হাত’ থেকেই ফিল্মি দুনিয়া আলাদা করে তাঁকে চিনতে শুরু করল।
পরের বছর ১৯৬৩ তে ‘ফুল বনে অঙ্গারে’। এই ছবি থেকেই যেন আনন্দ বক্সীর আসল ‘ইমপ্যাক্ট’ দেখা গেল।
দু বছর পর ১৯৬৫ তে কল্যাণজি আনন্দজীর ‘জব ফুল খিলে’ দারুন জনপ্রিয়তা পেল।
১৯৬৭ তে ‘পওয়ান কা মাহিনা, শাওয়ান করে শোর’ তাঁকে এনে দিল হিন্দি ছবির জগতে প্রথম সারির গীতিকারের মর্যাদা।
‘শোলে’, ‘এক দুজে কে লিয়ে’, ‘অমর- আকবর-অ্যান্টনি’, ‘ববি’, দো রাস্তে, ‘ফর্জ’ একের পর এক হিট।
কখনও লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল কখনও রাহুল দেববর্মন। চিঙ্গারি কোই ভড়কে, দম মার দম, হরে কৃষ্ণা হরে রাম, ওম শান্তি ওম লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। সহজ কথায় সহজ সুরে আলাদা করে মানুষ চিনে নিতে পারল আনন্দ বক্সীর গানকে।
আজও কেউ ভুলতে পারে না ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’, ‘এক থা গুল, এক থা বুলবুল’ এর মতো গানগুলো।
সুভাষ ঘাই এর ‘মঞ্জু’ ছবির জন্য গান লিখেছিলেন তিনি। হাসপাতালের বিছানায় । সেটাই তাঁর লেখা শেষ গান। ১৯৫৭ সালে যে সফর শুরু করেছিলেন ২০০২ সালে তা ফুরিয়ে যায়। এমনই শেষ জুলাই। মায়ানগরীতে তখন বর্ষা।