উস্তাদোঁ কে উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খান

এ আর রহমন।  হরিহরণ। শান। সোনু নিগম।

স্বর আলাদা। ঘরানা আলাদা। গায়কী আলাদা। মিল কিন্তু এক জায়গাতেই।

কী বলুন তো?

গুরুর নামে।

চার সঙ্গীত শিল্পীকেই সুর শিখিয়েছিলেন তিনি। একটাই নাম।

উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খান।

gumal-2

তাঁর ছাত্র-ছাত্রী তালিকায় আশা ভোঁসলে, গীতা দত্ত, মান্না দে, মায় লতা মঙ্গেশকর পর্যন্ত।

ছাত্রছাত্রীদের সাফল্যে অত্যন্ত খুশী হতেন। নিজের রাগ ঘরানকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। এভাবেই অক্ষুন্ন থাকত তাঁর গানের ধারা।

জীবনে প্রথমবার প্লেব্যাক করতে গিয়েছেন। একটি মারাঠি ছবির জন্য রেকর্ডিং। স্টুডিয়োতে পৌঁছে গিয়েছেন। হঠাৎ কানে এল, ‘ ক্ল্যাসিক্যাল সিঙ্গারকে ডাকা হয়েছে, এবার দেখো ওয়ার্মআপ করতে কতটা সময় নেয়!’

সময় মতোই রেকর্ডিং শুরু হল। এক টেকেই ‘ওকে’।

কাজ শেষ হয়ে গেলে সেই উক্তির বক্তাকে বলেছিলেন, ‘মেরা গলা হামেশা গরম রহেতা হ্যায়’

সেই ভদ্রলোকের উত্তর ছিল, ‘ভালো শিল্পী সব সময় তৈরী থাকে’।

মারাঠি ছবি দিয়ে পেশাদার শিল্পী জীবন শুরু হলেও হিন্দি এবং গুজরাটি ছবিতেও কণ্ঠ দিতেন। পরবর্তী সময়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন প্লেব্যাক থেকে। অনুরোধ, উপরোধ, প্রস্তাব কম আসেনি। কিন্তু রাজী হননি। নিজের ঘরানাকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজকেই জীবনের একমাত্র কাজ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।   

 তাঁর জন্ম মূহুর্তেই স্থির হয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবনের গতিপথ।

রামপুর-সাহাশওয়ান ঘরানার সার্থক উত্তরাধিকার তিনি। এই ঘরানাকে পরিপুষ্ট করে তোলার দায়-ভারও তাঁর কাঁধেই। কিন্তু সেই আশাও একবার ছেয়ে গিয়েছিল অনিশ্চয়তার কুয়াশায়।

কথা বলতে শিখেছিলেন দেরীতে। ২ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পরেও ছেলের মুখে বোল ফুটছে না দেখে খুব চিন্তায় পড়েছিলেন বাবা-মা। কিন্তু হাল ছাড়েননি তাঁরা। ছেলের মুখে কথা ফোটাতে সুরই ছিল একমাত্র সম্বল।

 বাবা উস্তাদ আরিস হুসেন খান। মা সাবরি বেগম রামপুর-সাহাশওয়ান ঘরানার জন্মদাতা উস্তাদ ইনায়েৎ হুসেন খানের মেয়ে। 

দুধের শিশুকে রোজ বুকে নিয়ে ধুন শোনাতেন বাবা। আরিস হুসেন খানের বিশ্বাস ছিল এভাবে শুনতে শুনতে একদিনগলা খুলে যাবে। কথা বলতে শিখবে ছেলে।

সত্যি হয়েছিল তাঁর বিশ্বাস। হঠাৎই একদিন কানে আসে ছেলের বোবা মুখে ‘ইয়া ইয়া ইয়া’  শব্দ । যেন বাবার ধুনের প্রতিধ্বনি। তার পর থেকে নিয়মিত চলল বাবা-ছেলের এমন দ্বৈত।

কথা বলা শিখতেই আর অপেক্ষা করেননি তাঁরা। সোজা গুরুর কাছে নাড়া বাঁধার পর্ব। বাবা আর কাকার কাছে হাতেখড়ির পর নিসার হুসেন খান তাঁর জীবনের প্রথম গুরু। গোয়ালিয়র ঘরানাতে

ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ‘গুরু কা হুকুম মাননা জরুরি হ্যায়’।

সেই শিক্ষাই তাঁর সারা জীবনের মন্ত্র হয়েছিল।

ছোটবেলাটা কেটেছে বাবার কড়া নজরে। পাড়া-প্রতিবেশিদের বলে রেখেছিলেন, যদি কোনদিন কেউ ছেলেকে রিয়াজের সময় বাড়ির বাইরে দেখেছে তাহলে যেন হিড়হিড় করে টেনে বাড়িতে দিয়ে যায়।

মা-ও রিয়াজ নিয়ে তেমনি কড়া। এতটুকু এদিক-ওদিক দেখলেই সোজা বাবার কাছে।

এভাবেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা। অসম্ভব ধৈর্য, জেদ, সাধনা আর সুরের প্রতি ভালোবাসা সব মিলিয়ে  উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খান। ওস্তাদদের ওস্তাদ।

gulam-1

দেশের অন্যতম সেরা সঙ্গীতশিল্পী শুধু নন, আদর্শ শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীরা প্রায় সকলেই সুরের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিন্তু নিজেকে ‘সেরা শিক্ষক’ হিসেবে মানতে খুব একটা রাজী ছিলেন না এই মানুষটি।

মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ‘উস্তাদ নিজেও আসলে ছাত্রই, প্রকৃত এবং আসল গুরু তো একজনই, তিনি ঈশ্বর’   

  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...