ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার। আলোর ধারায় ঝলমলিয়ে ওঠা আইফেল বহু মানুষের কাছে স্বপ্ন। রাতের অন্ধকার ম্লান হয়ে যায় আইফেলের জৌলুসের কাছে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকরা ক্যামেরাবন্দি করে সেই দৃশ্য। কিন্তু আকাশ ছোঁয়া লোহার টাওয়ারকে রঙিন আলোর জাদুতে যিনি সাজিয়ে তুলেছিলেন সেই নেপথ্যের শিল্পী আজীবন অন্ধকারেই থেকে যান। কেউ মনে রাখেনি তাঁকে। বিদেশ তো বটেই এমনকি তাঁর নিজের শহর।
বিশিষ্ট অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন একবার ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন এ নিয়ে। তিনি বলেছিলেন এইসব খবর কী তবে যথেষ্ট ‘সেনশেসন্যাল’ নয় বলেই এভাবে দেশের মানুষের উপেক্ষার শিকার হতে হয় শিল্পীকে! দেশ তাঁকে মনে রাখে না। এমন অনন্য প্রতিভা যথাযথ সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়। উত্তরটা এভাবেই খুঁজে নিয়েছেন তিনি।
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম, প্যারিসের গর্ব, আইফেল টাওয়ারকে আলোর মায়ায় মুড়ে দিয়েছিলেন এক বাঙালি। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ব্রিজকেও তিনিই সাজিয়েছিলেন আলোক মালায়। হাওড়া ব্রিজের সেই আলো আজ আর নেই। শিল্পীও নিভে গিয়েছেন। প্রিয় শহর মনে রাখেনি তাঁকে। তিনি আলোর যাদুকর তাপস সেন।
ইংল্যান্ডের বিখ্যাত আলোশিল্পী রিচার্ড পিলব্রো তাঁর লেখায় তাপস সেন সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘...অবিশ্বাস্য রকমের সামান্য কিছু উপকরণ, কয়েকটি ল্যাম্প, আমাদের নিত্য ব্যবহার্য কয়েকটি জিনিস আর ছায়া—এই দিয়ে তিনি আলোর জাদু দেখাতেন।’
কাচের গ্লোব, বাঁশপাতা, ছেঁড়া কাপড়, হ্যারিকেন এমন সব তুচ্ছ উপকরন দিয়ে তিনি মায়া সৃষ্টি করতেন মঞ্চে। আলো আঁধারীর খেলায় ডুবিয়ে রাখতেন দর্শককে। আলো আর অন্ধকারের যাদুতে তিনি চিরকাল আলোর তপস্যী। মেধা মননে জাত শিল্পী।
অসমের গোয়ালপাড়া জেলার ধুবড়িতে জন্ম। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯২৪। ঠাকুরদার বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বিক্রমপুরে। কিন্তু বাবা থাকতেন অসমে। পিতার নাম মতিলাল সেন মায়ের নাম সুবর্ণলতা সেন।
বয়স যখন এক বছর বাবার চাকরির সূত্রে দিল্লি চলে যেতে হয়। তখন থেকেই শুরু প্রবাসী জীবন। বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সবটাই গালিবের শহরে। ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র কিন্তু প্রবল টান ছবি আঁকা, নাটক আর আলোর প্রতি। হাতে খড়ি হয়েছিল স্কুল জীবনে। ড্রইং শিক্ষক প্রতাপ সেনের উৎসাহে। তাঁর উৎসাহেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে "রাজপথ" নাটকে প্রথম আলোর দায়িত্ব পান। তখন স্কুল জীবন প্রায় শেষের দিকে। নাটকে রাস্তার দৃশ্যে ল্যাম্পপোস্টের আলো তৈরি করেছিলেন। সেই দিনই যেন নির্ধারিত হয়ে গেল বাকি জীবনের নিয়তি।
প্রথমে নিউ দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে, তারপর আরউইন হাসপাতালে, শেষে দিল্লি ক্যান্টনমেন্টে সিপিডব্লিউডির ইলেকট্রিক বিভাগে চাকরি করতেন। মাইনে সে সেময়ের নিরিখে নেহাত খারাপ না। কিন্তু চার-দেওয়ালে বন্দি হয়ে কাগজ- কলমে ‘অফিসবাবু’র চাকরি দমবন্ধ হয়ে আসত। টানাপোড়েন বেশি দিন চলল না। চাকরী ছেড়ে পাড়ি দিলেন তখনকার বম্বে অর্থাৎ মুম্বইতে। ক্যামেরা ও আলোর কাজ শেখার জন্য।বিখ্যাত ফটোগ্রাফার দিলীপ গুপ্তর কাছে ফটোগ্রাফির কাজ শুরু করেন।
১৯৪৭- এ কলকাতায় চলে এলেন। দিল্লিতে থাকাকালীন গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই টানেই কলকাতায় এসেও বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন।
এদিকে আর্থিক সংকটও চরমে। বছর দুয়েক এভাবে চলার পর চাকরি পেলেন নিউ থিয়েটার্সে। নিউ থিয়েটার্সের আর্থিক অবস্থা তখন বিশেষ ভাল নয়। তাঁর মধ্যেই জীবনে প্রথমবার সিনেমায় কাজের সুযোগ মিল্ল। সৌরিন সেনের ছবি ‘রূপকথায়’। তিনি সহকারী পরিচালক। সৌরিন সেন সে সময়ের নাম করা আর্ট ডিরেক্টর। ছবির কাজে যুক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারেননি। নিউ থিয়েটার্সে আরও এক মোড় ঘোরানো ঘটনা ঘটেছিল তাঁর সঙ্গে। বন্ধুত্ব হয়েছিল হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর সূত্রেই আলাপ মৃণাল –ঋত্বিক- বিজন-সলিলদের সঙ্গে।
কলকাতায় থিয়েটারের মঞ্চে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঋত্বিক ঘটকের ‘জ্বালা’ প্রযোজনা দিয়ে। প্রথম অভিনয় লেক টেম্পল রোডের কালচার ক্লাবে। পাঁচের দশকের গোড়া থেকে কলকাতার বহু সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন। সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটাড়। সব জায়গাতেই তিনি আলোর শিল্পী। ধীরে ধীরে তাঁর ‘সিগনেচার’ স্টাইলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠল শহর। শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তের সঙ্গে কাজ করেছেন। কল্লোল, অঙ্গার, ফেরারী ফৌজ, সেতু, তিতাস একটি নদীর নাম, রক্তকরবী- এমন সব অসামান্য প্রযোজনা। সংলাপ, মঞ্চ, অভিনয় যেন দৃশ্যে-দৃশ্যে খুন করত দর্শকদের।
তাপস সেন মনে করতেন, ছায়া বা আঁধার না থাকলে আলোর মর্ম পরিস্ফুট হয় না। আড়ালে থাকতে ভালোবাসতেন। নিজেকে বলতেনও ‘আড়ালের মানুষ’। তবু তাঁর আলোর কাছে আনত হতে হয়েছিল সারা পৃথিবীকে। ১৯৭২ সালে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ‘লাইট ডিজ়াইনার’-এর স্বীকৃতি পান। তবু তিনি নেপথ্যেই।
২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে জুন তাপস সেন কলকাতায় নিজ বাসভবনে প্রয়াত হন। মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকার করেছিলেন। তাঁর নশ্বর শরীর চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহারে দান করা হয়।