কবিতায় ‘নিপাত যাও--ধ্বংস হও--ভাঙো’(‘ধ্বংস করো ধ্বজা’ কবিতা)-উচ্চারণে প্রতিবাদের আগুন জ্বেলে দিতে কোন রাজনৈতিক পতাকার নীচে দাঁড়াতে কখনই প্রবৃত্তি হয়নি কবি শঙ্খ ঘোষের। তিনি শুধু মানবতার কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন, আর কারও কাছে ছিলেন না। আপোষহীন এই কবি জানতেন—
‘সত্য থেকে সঙ্ঘ হতে পারে
সঙ্ঘ তবু পাবে না সত্যকে।’ (‘সত্য’-কবিতা)।
তাছাড়া, চোখের সামনে তো দেখেইছিলেন, কেমন করে ‘এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়।’ (‘সঙ্ঘ’ কবিতা)। তাই প্রতিবাদের পথে তিনি প্রয়োজনে একা হেঁটেছেন। তাঁর এই পথটি অবশ্য সমকালীন অনেক তরুণ কবিকেই আকৃষ্ট করেছিল। তাই এই পথে তিনি একা হলেও যেন একা ছিলেন না, তাঁর পথের রেখায় অনেকেই শামিল ছিলেন—
‘সঙ্ঘে আমি একলা থাকি বটে
একার পথে সঙ্ঘ টের পাই।’ (‘সত্য’-কবিতা)।
তথাকথিত ‘পরিবর্তনের’ কালে অনেকেই যখন আর একটা চল্লিশ বা আর একটা সত্তর আসছে ভেবে উল্লসিত হয়ে ময়দানে নেমে পড়েছিলেন। শুরু হয়েছিল ‘আমরা’-‘ওরা’-র টানাটানি। তখনও কবি ঋষির মতো স্থির হয়ে ‘তারা’-দের জন্য কলম ধরেছিলেন। বুঝেছিলেন, উল্লাস থামলেই শুরু হবে পাওনাগণ্ডার হিসেব! সেটাই একজন শিল্পীর সঙ্কটের সময়, তখন—
‘ঈষৎ মাত্র গিলে নিলে
যা সওয়াবেন তাই সয়।’ (‘পাগল’-কবিতা)।
ওই ‘সয়ে’ নেওয়াটাকেই তিনি সইতে পারতেন না। তাই অবক্ষয়ে ঘুমিয়ে পড়া প্রতিবাদী সত্তাকে খুঁচিয়ে তোলার জন্য আমাদের নিত্যদিনের সয়ে নেওয়া, আপাতসাধারণ লবজও তাঁর কলমে শানিত সায়ক হয়ে উঠত।
এই যেমন ধরুন, বাস থেকে ভিড় ঠেলে নামতে গিয়ে রোজই তো শুনি, ‘ছোট হয়ে নামুন, সরু হয়ে নামুন’, ‘রাস্তা কেউ দেবে না, রাস্তা করে নিন’ কিংবা ‘ও দাদা, একটু নড়ে চড়ে দাঁড়ান, একটু চাপ দিন’। সত্যি বলতে কী, এসব আমরা শুনি ঠিকই, গা করিনা।
কিন্তু এগুলোই তাঁর কলমে কবিতা হয়ে উঠত, গভীরতা নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াত। বলত, ওই সাধারণ কথা নেহাত সাধারণ না, ওদের মধ্যে রয়েছে বড় কিছু সইয়ে নেবার পূর্বসূত্র। তাই ঐ আপাতনিরীহ কথাগুলোর সূত্র ধরেই তিনি আমাদের প্রতিনিধি হয়ে উচ্চারণ করেছিলেন :
‘আরো কত ছোটো হব ঈশ্বর
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে!
আমি কি নিত্য আমারও সমান
সদরে, বাজারে, আড়ালে?’
কিংবা,
‘এক রাস্তা দুই রাস্তা তিন রাস্তা কেউ রাস্তা
রাস্তা কেউ দেবে না, রাস্তা করে নিন।
তিন রাস্তা চার রাস্তা সব রাস্তা সমান
রাস্তা করে নিন।’
কিংবা,
‘একটু মশাই নড়ুন
ভিতর থেকে নড়ুন
চাপ সৃষ্টি করুন...’
তিনি জানতেন, সাধারণ কথাই ঘুরিয়ে বলতে পারলে সাধারণের মনে দাগ কাটে। তাকে সচকিত করে। তাই এই সব উচ্চারণের অভিঘাতে আমাদের ঘুমন্ত সত্তা আজ এখনও জেগে উঠে প্রতিবাদী হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চায়...
আমাদের অলস চৈতন্যের মাটিতে কবি যেন এভাবেই বারে বারে বহুবছর ধরে বুনে যেতেন প্রতিবাদের বীজ। এখনও তাঁর কবিতা বুনে যায়। শুনিয়ে যায় জেগে ওঠার মন্ত্র, ঘুরে দাঁড়ানোর গান।
প্রতিবাদে তিনি 'উচ্চারণ' পছন্দ করতেন, গালাগালি নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, গালাগালি কখনো সক্ষমের হাতিয়ার হতে পারে না। ওটা অক্ষমের শেষ অস্ত্র। এদিক থেকে এক রাবীন্দ্রিক বিশুদ্ধতা তাঁর মধ্যে সতত বিরাজমান ছিল, ছিল প্রজ্ঞার প্রতি প্রগাঢ় আস্থা। এ-বিষয়ে একটা ঘটনা বহুল শোনা যায়:
শঙ্খ তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। কবিতানিষ্ঠ ছাত্রদের প্রশ্রয় দেন। কবিতার পথচারীদের পথ দেখান। সেখানেই তাঁর প্রিয় ছাত্র ছিলেন কবি জয়দেব বসু। জয়দেব দারুণ প্রতিভাবান কবি, সেই সঙ্গে ব্যাপক বেপরোয়াও। সেই জয়দেব অনেক বার বিপাকে ফেলে অনেক চেষ্টা করেছিলেন শঙ্খ ঘোষের মুখ দিয়ে গালাগালি বার করানোর। পারেননি। শেষমেশ একদিন ক্লাস খালি করে বলেছিলেন, স্যার, এখন তো কেউ নেই, একবার বলুন না 'শালা'!
নাহ, তারপরেও এক টুকরো কৌতুকময় মুচকি হাসি ছাড়া তাঁর ঠোঁট থেকে জয়দেব আর কিছুই বের করতে পারেননি।
শঙ্খ ঘোষ মানেই, ক্ষমাশীল এক সুন্দর। তাঁর আবাস ছিল পরবর্তী কবিদের কাছে পরম আশ্রয়। ছিল, নিরবচ্ছিন্ন এক আকাশ। আর স্বয়ং শঙ্খ ছিলেন সেই আকাশের ধ্রুবতারা। ভাষা, ছন্দ আর প্রবণতার অন্ধকারে যাঁরা পথ হাতড়ে বেড়াতেন, তিনি প্রজ্ঞার উজ্জ্বল আলোয় তাঁদের সেই পথ চিনিয়ে দিতেন। কবিতার এই পাঠশালায় অনেকেই তাঁকে অনুসরণ করেছেন ঠিকই; কিন্তু প্রতিবাদের ক্ষেত্রে দল-নির্বিশেষ যে বিশুদ্ধ ও বলিষ্ঠ অবস্থানটি তাঁর ছিল, সেটি এখনও পর্যন্ত কেউ অনুসরণ করার সাহস দেখাতে পারেননি। ফলত এ-পথে আজও তিনি ব্যতিক্রমী ও অদ্বিতীয়; তাই তিনি আমাদের পরম শ্রদ্ধেয়।