“বাংলা ভাষা নিয়ে অহংকার করতে শিখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, শিবরাম, মুজতবা আলি। সত্যজিৎ প্রথম শিখিয়েছেন ক্যামেরা দিয়ে গল্প বলা যায়। চাইলে কবিতাও”।
নিজের প্রথম শিখতে শেখা নিয়ে সম্পাদকীয়র পাতায় যিনি এই কথাগুলো লিখেছিলেন তিনি নিজেই শব্দ-ছবির মিশেলে এক আশ্চর্য মানুষ।
প্রতিটা রেখায়-লেখায়-রিলে রেখে গিয়েছেন নিজস্ব ছাপ। নিত্য নতুন ফর্মে, ডায়ামেনশনে ভেঙেছেন নিজেকে। আবার গড়েওছেন। প্রতিবারই যেন নতুন মানুষ। নতুন মুক্তির সন্ধান। সিনেমা কোথায়! সবটাই তো তিলে তিলে গড়ে তুলতে চাওয়া নিপুণ জীবন! ক্রমাগত তাকে বিচ্যুতিহীন করে তোলার চেষ্টা। নব নব রূপে। পরম মমতায় জীবনের গায়ে হাত রাখছেন এক অন্য আলোর মানুষ। ঋতুপর্ণ ঘোষ।
খুব ছোটবেলা থেকে 'মহাভারত’ -এর প্রতি টান তৈরি হয়েছিল। বাবার কাছে শিখেছিলেন মহাকাব্যের পাঠ। রোজ হোমওয়ার্ক সেরে বসতেন বাবার কাছে। সঙ্গে ঠাকুমা। রাজশেখরী মহাভারতের তন্ময় পাঠে ভরে উঠত সাঁঝবেলার ঘর। শিরায়- শিরায় শিহরণ জাগত ছোট্ট-ছেলেটার। চোখের সামনে যেন জলজ্যান্ত সিনেমা। ইন্দ্রানী পার্কের 'তাসের ঘর' বাড়ির পর্দা ঢাকা ঘরটা তখন কুরুক্ষেত্র প্রান্তর। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ডাগর চোখে সবটা দেখছে সে! যেন এক অন্য অপু।
সেই প্রভাব এমনই যে প্রথম স্কুলের দুনিয়ায় পা রেখে নিজেই বদলে নিয়েছিলেন নিজের নাম। বাড়িতে নাম রাখা হয়েছিল ‘সৌরনীল’ সেই মিলিয়েই ভাই ‘ইন্দ্রনীল’। কিন্তু বাড়ির 'সৌরনীল' স্কুলে পা দিয়েই রাতারাতি ‘ঋতুপর্ণ’।
বদলের প্রবণতা ছোটবেলা থেকেই। সারা জীবনের সঙ্গী।
কখনও ছবিওয়ালা, কখনও গান লিখিয়ে কখনও অভিনেতা, কখনও সম্পাদক, কখনও বা শুধুই লেখক। এর বাইরেও যে কত কত দিক আছে তাঁর! আলপনা আঁকতেন। কনে-চন্দনের নিবিড় রেখায় ফুটে উঠত আটপৌরে ভালোবাসা। সৃজনশীলতার সবকটি দিকেই ব্যপ্ত করেছিলেন নিজেকে। ঋতুপর্ণ ঘোষ এক বহুমুখী সত্ত্বার মানুষ। একের মধ্যে অনেক।
কেরিয়ার শুরু করেছিলেন কলকাতার একটি নামকরা বিজ্ঞাপন সংস্থায়। সালটা ১৯৮০। কমার্শিয়াল দুনিয়ায় শুরু থেকেই তিনি সবার থেকে আলাদা। ভাষার মাধুর্যে, ছন্দের লাবণ্যে, তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিনতম ব্যাপার।
এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, কালো ফ্রেমের চশমা, গোল-গলা টি-শার্ট আর গভীর দুটো চোখ। শান্ত দীঘির দৃষ্টি। কিন্তু সেই দৃষ্টি যেন মনের গভীরতম তলটিকে অভ্রান্তভাবে দেখে নেয়। সাদা কাগজের গায়ে শিরশিরিয়ে ওঠে কালো হরফ। খসখস শব্দে।
তখনও সেরার মঞ্চে তিনিই সেরা। লক্ষভেদী দৃষ্টি। যা করতে চান, তা তিনি করবেনই।
দুরদর্শনের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন। বিষয় ‘সত্যজিৎ’। তিন-তিনটে তথ্যচিত্র বানাবার কথা ছিল। বিষয়ের ওপর তুখোড় গবেষণা। প্রতিটা ডিটেলিং-এ নজর। সময় লাগত। সময় দিতেন। সেই ভিতেই গড়ে উঠত বিষয়ের শরীর।
নিজেকে বলতেন ‘আমি লিখিয়ে নই’। অথচ ২০ বছরের সিনেমা জীবনে তিনি লিখেই গিয়েছেন নিরন্তর। কখনও কালি-কলমে। কখনও সেলুলয়েডে। অনুচ্চারিত ভাবে বহন করে চলেছিলেন এক পরম্পরা। রবীন্দ্রনাথ, অবন ঠাকুর, বিভূতিভূষণ, সত্যজিৎ, লীলা মজুমদার যেন নিবিড় ভালোবাসায় মিলেমিশে একাকার সেখানে। লেখা কি শুধু পড়ার? লেখা যে দেখারও। কীভাবে শব্দে শব্দে জন্ম দিতে হয় ছবির, কোন মায়াগানে রক্তে মিশে থাকা ঘুমন্ত রিলগুলো জেগে ওঠে, সেই সুর তিনি জানতেন। হ্যামিল্টনের বাঁশিওয়ালা। অথবা যেন মোহন অভিসারের গান।
চরিত্ররা বলত অভিব্যক্তিতে। শব্দের চেয়ে বেশি অভিঘাতে।
ট্র্যাজিক নায়িকা, বিরহিনী, অভিমানিনী, উগ্র পুরুষ, পাখির মতো তিরতির করে কাঁপতে থাকা ভীতু অন্তঃপুরবাসীনী, শহুরে আধুনিকতা, মধ্যবিত্ত গৃহী - এমন অসংখ্য মুখ। নির্বাক চাহনি নিয়ে দর্শকদের মনের মধ্যে মগজের ধারে প্রবল ভাবে জানান দিয়ে গিয়েছে তাদের উপস্থিতি। এড়াতে চাইলেই তাদের এড়ানো যায় না। বরং নিয়তির মতো ঘিরে ধরে। কালবৈশাখী হাওয়ায় তছনছ করে যায় ঘর-দুয়ার। ভাঙচুর চালায়। বদল আনে। কখনও সে বদল বড় অস্বস্তিকর। যেমন তাঁকে নিয়েও আজীবন প্রবল অস্বস্তিতে ভুগেছে তাঁর নিজের শহর। আবার এড়াতেও পারেনি ঋতুপর্ণ নামের চুম্বকীয় টান। মোহময় মেধা। লালিত সৌন্দর্য। সুতীব্র নারী সত্ত্বা। গান্ডিব-ধনুষে যে নশ্বর চিত্রাঙ্গদা।
নিজেকে ‘ছবি করিয়ে’ বলতেও আপত্তি ছিল। তাহলে তিনি কী?
নিজের ভাষায় নিজেকে বলেছেন, ‘যতদূর বুঝি আমি এক সাধারণ বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ’।
আসলে এ শহর যেন কোনওদিনই তাঁকে বুঝে উঠতে পারেনি। লিঙ্গ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ‘ মানুষ’ পরিচয় চেয়েছিলেন। আজীবন। পুজো নয়, চেয়েছিলেন সম্মান। সম্ভ্রম। যার কোনও লিঙ্গভেদ হয় না। যে মেধার কাছে পদানত হয় ভ্রান্ত কথার পৃথিবী।
শেষ পর্যন্ত আর তেমনটা হয়ে ওঠে না। বোধ হীন ব্যক্তিপুজো চলে।
তেমন করে অন্তরমহলের ব্যথার আগল খুলবে কে? কে-ই বা পাখি-চক্ষু তূনে হৃদয়ের দ্বারে আঘাত হানবে। মরমে প্রবেশ তাই থমকে থাকে। ব্রজবুলির সুরে ভিজতে থাকে মনহীন শহর। ভোর-ভোর বৃষ্টিতে রাজার সাজে সেজে ফিরে যায় একা অভিমানিনী। বিফল মনরথে নিজবাসে। তার পায়ের শব্দে কিঙ্কিনী বাজে কি বোঝা যায় না।
ভাঙচুরবিলাসী মানুষটিকে এই পরবাসী শহর আর বুঝতে পারল কই!
তথ্য ঋণ- (ফার্স্ট পার্সন- ঋতুপর্ণ ঘোষ)