রামজয় বিদ্যাভূষণ উনিশ শতকের প্রথমার্ধের বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত। তাঁর বাড়ি ছিল কলকাতার ঝামাপুকুরে। উনিশ শতকের প্রথম অর্ধ কৌলীন্য বজায় রাখার যুগ। রামজয় তাই কন্যা শ্রীমতীর বিবাহ দিয়েছিলেন নবগ্রামের কুলীনসন্তান জীবনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বিবাহের পর জীবনকৃষ্ণ শ্বশুরের আশ্রিত হয়েই রয়ে গিয়েছিলেন, বাড়ি আর ফেরেননি। জীবনকৃষ্ণের শিক্ষাদীক্ষা বিশেষ ছিল না, তাই বিদ্যার বিনিময়ে কর্মলাভের কোন আশাও তাঁর ছিল না। তাছাড়া কুলীনের রীতি অনুযায়ী অলস জীবনযাপনেই তিনি অভ্যস্ত ছিলেন।
জীবনকৃষ্ণের প্রথম সন্তান কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর জন্মকাল ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে। কৃষ্ণমোহনের পরে শ্রীমতী আরও দুটি পুত্র এবং একটি কন্যার জন্ম দেন। সাকুল্যে ছ’জনের এই পরিবারটিকে একা রামজয়ের পক্ষে লালনপালন করা ক্রমে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া ঘরে স্থানেরও সংকুলান হচ্ছিল না। কাজেই একদিন রামজয় সেকথা মেয়েজামাইকে বলে এককালীন কিছু টাকাপয়সা দিয়ে অন্যত্র বাস করার কথা বললেন। তখন উপায় না-দেখে জীবনকৃষ্ণ সেই টাকায় গুরুপ্রসাদ চৌধুরি লেনে বাড়ি তৈরি করে উঠে গেলেন। এতে নিজস্ব একটি আশ্রয় হল বটে, কিন্তু আহার সংস্থানের উপায় রইল না।
আগেই বলেছি জীবনকৃষ্ণ কুলীনসন্তান, খেটে খাবার সামর্থ্য বা সদিচ্ছা কোনটাই তাঁর ছিল না। কাজেই দারুণ অভাব এসে সংসার একেবারে ঘিরে ফেলল। শ্রীমতী ছিলেন মানুষ হিসেবে একেবারে অন্যরকম। তিনি নিরুপায় হয়েও পিতার কাছে হাত পাতলেন না। আবার ছেলেমেয়ের মুখে অন্ন উঠছে না-এটাও দেখতে পারলেন না। কিন্তু বাইরে গিয়ে যে কাজ করবেন, সেকালে তারও উপায় মেয়েমানুষের ছিল না। তাই বাড়িতে বসে যে-কাজ করে সামান্য অর্থ উপার্জন করা যায়, অনেক কষ্টে সেই কাজ ধরলেন। দিনরাত এক করে কাপড়ের সুতো কেটে, পৈতের সুতো কেটে, পাটের দড়ি পাকিয়ে কায়ক্লেশে সংসার চালাতে লাগলেন।
কৃষ্ণমোহন ছোট থেকেই বেশ মেধাবী ছিলেন। অল্পেই শিখে ফেলার গুণ তাঁর মধ্যে ছিল। সেকালে শিক্ষাতেও ছিল ফেল কড়ি মাখো তেল-গোত্রের ব্যাপার। ছিল, মাস মাইনের ফর্দ। অভাবের সংসার পেরিয়ে কড়ি খরচ করে ছেলেকে পড়াশুনো শেখানোর উপায় শ্রীমতীর ছিল না। হেয়ার সাহেব কালীতলায় তখন একটি অবৈতনিক স্কুল স্থাপন করেছিলেন, তাতেই তিনি ছেলেকে ভর্তি করলেন। কৃষ্ণমোহনের মেধা অল্পদিনেই হেয়ার সাহেবের চোখে পড়ল। তখন থেকেই তাঁর অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠলেন কৃষ্ণমোহন। হেয়ার স্কুল থেকে হিন্দু কলেজ পর্যন্ত কৃষ্ণমোহনের পাশে থেকে মাসমাইনে ছাড়াই তাঁর পড়াশুনোর ব্যবস্থা করে দিলেন।
পুত্র হিসেবেও কৃষ্ণমোহন ছিলেন অন্যরকম। দিনভর সংসারের হাল টানতে মায়ের হাড়ভাঙা খাটুনি তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সেই ছোট থেকেই। তাই মাকে সামান্য স্বস্তি দিতে তখন থেকেই দুপুর ও রাত্রের রান্নার কাজ তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। এরপরেও বছর বছর কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি প্রতিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেন। তাতে হেয়ার সাহেব তাঁর প্রতি এতটাই তুষ্ট ছিলেন যে, হিন্দু কলেজ থেকে পাশ করতেই তাঁকে নিজের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করে নিলেন।
হিন্দু কলেজে পড়ার সময়ই কৃষ্ণমোহন শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ডিরোজিওকে। ডিরোজিওর দার্শনিক চিন্তা, প্রগতিশীল ভাবনা, সবকিছু প্রশ্ন করে যাচাই করার দৃষ্টিভঙ্গি কৃষ্ণমোহনকে তাঁর প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট করল। একই সময়ে তাঁর মতো আরও অনেক ছাত্রই ডিরোজিওর প্রতি অনুরক্ত হল। ডিরোজিওকে কেন্দ্র করে তখন তৈরি হল একটি বলয়। যে বলয়ের নাম দেওয়া হল, ‘ইয়ং বেঙ্গল’।
‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর নেতৃত্বে পুরনোকে বিসর্জন দিয়ে নতুন সামাজিক রীতির প্রবর্তন ও প্রথাভাঙার জন্য যুবকদের মধ্যে প্রবল উন্মাদনা দেখা দিল। তাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রথম ধাক্কাটা এসে লাগল ধর্মের গায়ে। আমাদের সমস্ত রীতিনীতির সঙ্গে ধর্ম এমনভাবে সম্পৃক্ত যে, এই ধাক্কায় হিন্দুদের মধ্যে ‘গেল গেল’ রব উঠল। হিন্দু সমাজের হয়ে ইয়ং বেঙ্গলীদের আক্রমণ করতে প্রসন্ন ঠাকুর ‘রিফরমার’ নামের পত্রিকা প্রকাশ করলেন। অমনি কৃষ্ণমোহন পাল্টা ‘ইনকুইরার’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করে হিন্দুধর্মের প্রতি আক্রমণ শানাতে লাগলেন।
ইতোমধ্যে ঘটে গেল একটা ঘটনা। ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর সদস্যরা কৃষ্ণমোহনের বাড়িতে নিয়মিত বৈঠক করতেন। যে-দিনের কথা বলছি, সেদিন তিনি তখনও স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেননি। কিন্তু তাঁর বাড়িতে ইয়ং বেঙ্গলীরা মিলিত হয়ে প্রথাভাঙ্গার উন্মাদনায় কাণ্ডজ্ঞান হারালেন। মুসলিম হোটেল থেকে রুটি ও মাংস আনিয়ে, খেয়ে, প্রতিবেশীদের বাড়িতে হাড়গুলো ছুঁড়তে ছুঁড়তে ‘গরুর হাড়, গরুর হাড়’ বলে চিৎকার জুড়ে দিলেন। তাতে প্রতিবেশীরা রেগেমেগে একেবারে মারমুখো হয়ে তাঁদের তাড়িয়ে সোজা রামজয়ের কাছে গিয়ে অভিযোগ শানাল। কৃষ্ণমোহনকে ত্যাগ না-করলে সমাজচ্যুত করার ভয় দেখাল। ঘটনায় কৃষ্ণমোহনের কোন মদত বা উপস্থিতি না-থাকলেও সমাজের কাছে নত হওয়া ছাড়া রামজয়ের উপায় ছিল না। তাই সন্ধ্যেয় কৃষ্ণমোহন বাড়ি ফিরলে মেয়ের বাড়ির সামনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁকে আর ঢুকতে না-দিয়ে সদর দরজা থেকে তাড়িয়ে দিলেন।
বিতাড়িত কৃষ্ণমোহন বন্ধুর বাড়ি বাড়ি কিছুদিন আশ্রিত হয়ে রইলেন। কিন্তু ক্রমে সেখান থেকেও তাড়িত হয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাস করতে শুরু করলেন। অবশেষে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই হেদুয়ার ধারে খ্রিস্ট-মন্দির তৈরি করে ‘রেভারেন্ড’ হয়ে সেখানেই উপাসনা ও বসবাস করতে শুরু করলেন। এই সময় তাঁর স্ত্রী বিন্ধ্যবাসিনী ও ছোটভাই কালীমোহন তাঁর অনুগামী হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন। পুরো ব্যাপারটায় কলকাতার সমাজে একটা ব্যাপক শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। দীর্ঘকাল চলেছিল সেই আলোড়ন। তাতেই হিন্দুসমাজের মাথারা নড়েচড়ে উঠেছিলেন, এবং হিন্দুধর্মকে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জুড়ে তাকে সংস্কারের মধ্য দিয়ে উজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
শুধুমাত্র ধর্ম-পরিবর্তন করে সমাজকে একটা ধাক্কা দিয়ে তাকে সংস্কার-অভিমুখী করার মধ্য দিয়েই কৃষ্ণমোহনের কাজ শেষ হয়ে যায়নি। অমানবিক সতীদাহ প্রথা রদের জন্য রামমোহনের সমর্থনে জনমত তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। স্ত্রীশিক্ষার সপক্ষে আন্দোলন করেছিলেন। বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষায় সুপণ্ডিত এই মানুষটি হিন্দুধর্মের সমালোচনার মধ্য দিয়েই শুধু জীবন অতিবাহিত করেননি, হিন্দুধর্মের দর্শন ও শাস্ত্র যাতে সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষায় পড়তে পারেন, তার জন্য তা অনুবাদও শুরু করেছিলেন। ‘ষড়দর্শন সংবাদ’ (১৮৬৭), ‘ঋগ্বেদ সংহিতা’ (১৮৭৫) সেই উদ্যোগেরই পাণ্ডিত্যপূর্ণ ফসল। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ তের খণ্ডে ‘বিদ্যাকল্পদ্রুম’ নামের গ্রন্থ রচনা। কারণ, এটিই ছিল বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম বিশ্বকোষ।
‘বেথুন সোসাইটি’, ‘ভারতসংস্কার সভা’, ‘বঙ্গীয় সমাজ-বিজ্ঞান সভা’, ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ প্রভৃতি বাংলা ও স্বদেশের হিতকারী বহু সভা-সমিতির বহু হিতকর কাজের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন কৃষ্ণমোহন। তাই সারাজীবন ধরে বাংলার ধর্ম, সমাজ, ভাষা ও সাহিত্যের দিকবদলে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। উনিশ শতক বাঙালি জীবনে ও স্বদেশের স্রোতে যে নবজাগরণের কাল বয়ে এনেছিল, আমাদের জীবনকে নতুন আলোর দিকে আকৃষ্ট করেছিল; তাতে অনেক মনীষীর মাঝে এই মানুষটির অবদানও অনস্বীকার্য…