৪ জানুয়ারি, ১৯৫৮ । সুরেন ব্যানার্জি রোডের সেন্ট্রাল মিউনিসিপ্যাল অফিস বিল্ডিংসের কাউন্সিল চেম্বার। ফুল আর বাহারি পাতার অপূর্ব-সজ্জায় সাজানো। দেওয়ালে মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু, দেশপ্রিয় এবং নেতাজির ছবি; প্রতিটি ছবিতে ফুলের মালা। সামনে মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সত্যজিৎ রায়, মেয়র ডঃ ত্রিগুণা সেন, ডেপুটি মেয়র কেশবচন্দ্র বসু।
কাউন্সিল চেম্বার ভিড়ে একেবারে ঠাসা। অতিথির আসনে পরিচালক দেবকী বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, অভিনেত্রী চন্দ্রাবতী দেবী, সাংবাদিক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ। এছাড়াও সত্যজিৎ রায়ের ইউনিট মেম্বারদের মধ্য থেকে এসেছেন--কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিয় মুখার্জি, অনিল চৌধুরী প্রমুখ। শুরুতে সমবেত হাততালির মধ্য দিয়ে ত্রিগুণা সেন ফুলের মালা পরিয়ে সত্যজিৎ-কে বরণ করলেন। রূপোখচিত বাক্সে রাখা দ্বিভাষিক মানপত্র, ইংরেজি ও বাংলা। তাই দিয়ে তাঁকে সম্মান জানালেন। তারপর মানপত্র পাঠ করলেন, যার শুরুটা এরকম :
"হে অনন্যসাধারণ প্রতিভাধর শিল্পী, পৃথিবীর সমস্ত জাগ্রত জাতি যে-দুর্লভ সম্মান এবং স্বীকৃতি পাবার জন্য উন্মুখ, আজ তুমি ইওরোপের ও আমেরিকার সর্ব্বজনস্বীকৃত শ্রেষ্ঠতম বিচারক-মণ্ডলীর হাত থেকে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান আহরণ ক'রে নিয়ে এসেছ। তুমি বাংলার গৌরব, তুমি নবভারতের গর্ব্বের বস্তু--তোমাকে নমস্কার!"
--সংবর্ধনার এই বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল, "The Calcutta Municipal Gazette"-র 11.01.1958-র সংখ্যায় 'Civil Reception To Satyajit Roy' শিরোনামে। এই স্বদেশী সংবর্ধনা-সম্মানের আয়োজন হল 'অপরাজিত' ছবির জন্য ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে 'গোল্ডেন লায়ন অব সেন্ট মার্ক', 'সিনেমা ন্যুভো', 'ক্রিটিক্স এওয়ার্ডস' জয় করে আসার পর; কিন্তু তার আগে?
১১ অক্টোবর, ১৯৫৬। মুক্তি পেল, 'অপরাজিত'। 'বসুশ্রী', 'বীণা' এবং 'প্রাচী'-তে। মা ও ছেলের মনস্তত্ত্বকে 'অপরাজিত'-তে যেভাবে আতুপুতুগণ্ডির বাইরে সত্যজিৎ তুলে ধরলেন, তেমনটা বাংলা সিনেমায় এর আগে হয়নি। তবুও, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় : " 'অপরাজিত' অনাদৃত ছবি। চিত্রসমালোচকরা এমন বিরূপ সমালোচনা করলেন--শব্দযোজনা ও মতামতের ঐক্যে সেগুলোকে পূর্বপরিকল্পিত মনে হওয়া আশ্চর্য ছিল না। প্রচুর লোক দেখতে গেল না, আর যারা গেল তারা সংখ্যায় এত অল্প যে আমার মনে আছে, কলকাতায় সবচেয়ে বেশি চলেছিল একটা হাউসে--ছ সপ্তাহ। ব্যস, খতম।" ('সর্বজয়া'-গ্রন্থ)। সুতরাং, 'পথের পাঁচালী'-র বাঁধভাঙা সাফল্য একশ্রেণির পঙ্গপাল তৈরি করে ফেলেছিল। এবং তারা, সত্যজিতের দ্বিতীয় ছবিটা যাতে রমরম করে চলতে না-পারে, তার সুচতুর ব্যবস্থা করে ফেলল। এখনকার প্রেক্ষিতে ছ'সপ্তাহ নেহাত কম নয়। কিন্তু, ছবিটা আরও চলতে পারতো, চলতে দেওয়া হল না। সত্যজিৎ সাবোটাজের কথা বুঝতে পারেননি। স্রষ্টা হিসেবে তিনি কিন্তু নিজের সৃষ্টির দুর্বলতা খুঁজলেন এবং নিজেকেই দায়ী করতে লাগলেন : "চিত্ররূপটা লোকের মনে ধরেনি। দর্শকদের মনে হয়েছিল যে, আলাদা দুটো ফিল্মে তাঁরা আলাদা দুই অপুকে দেখছেন। অথচ তাঁরা হয়তো একই অপুকে দেখতে পেলে খুশি হতেন। সেইসঙ্গে আর-একটা কথাও আমার মনে হয়। সেটা এই যে, বড় অপুর সঙ্গে তার মায়ের সম্পর্কটা তাঁদের কাছে বড্ড-বেশি হৃদয়হীন বলে মনে হয়েছে।"('অপুর পাঁচালী')।
অথচ এই আপাত-নিন্দিত 'অপরাজিত'-ই একটা মানুষের গতিপথ আমূল বদলে দিল। তিনি, শান্তি চৌধুরী। গ্লাসগো থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে তিনি যখন দেশে ফিরলেন, তখন 'অপরাজিত' মুক্তি পেয়েছে। ভদ্রলোক সিনেমার পোকা, কাজেই ছবিটা দেখতে গেলেন। দেখে স্তম্ভিত হলেন। বাংলায় বসে এমন কাজও সম্ভব! আলাপ করলেন পরিচালকের সঙ্গে। ছবি দেখেই অবশ্য তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং নয়, সিনেমাই হবে তাঁর জীবন। প্রথমেই খুলে ফেললেন ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তিনিই নিয়ে গেলেন 'অপরাজিত'। তৈরি হল ইতিহাস। শান্তি চৌধুরীও শুধু ডিস্ট্রিবিউশনেই থেমে রইলেন না, হয়ে উঠলেন 'সংগস অব বেঙ্গল', 'সেকুলারিজম', 'হুসেন'-এর মতো পঞ্চাশেরও বেশি বিখ্যাত তথ্যচিত্রের নির্মাতা ও পরিচালক।
সত্যি বলতে কি, 'অপরাজিত' ভেনিসে গেল বলেই আমরা কিন্তু 'অপুর সংসার' পেলাম। নইলে হয়তো পেতামই না। মুক্তির দিনই খোদ রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ 'অপরাজিত' ছবিটি দেখতে চাইলেন। সত্যজিৎ নিজে দিল্লি গিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করলেন। দেখতে এলেন জওহরলাল নেহেরু এবং কন্যা ইন্দিরাও। ছবি শেষে মুগ্ধ নেহেরু সত্যজিতের কাছে জানতে চাইলেন, 'এরপর অপুর কী হবে?' সত্যজিৎ নির্দ্বিধায় বললেন, 'অপুকে নিয়ে তৃতীয় ছবি করার কোনও পরিকল্পনা আমার নেই।' অথচ এই মানুষটাই ভেনিসে সাংবাদিক সম্মেলনে, প্রায় একই প্রশ্নের উত্তরে এই নেতিবাচক উত্তরটি দিতে পারলেন না। তখনও জানেন না, 'অপরাজিত'-র পরের কাহিনি। জানার পরিকল্পনাও নেই। চলছে কেবল 'জলসাঘর' আর 'পরশ পাথর'-এর শ্যুটিং এবং প্রস্তুতি। তবু বলে বসলেন, অপু-ট্রিলজি তিনি বানাবেন! পরদিন সেকথা ফলাও করে সেখানকার কাগজে কাগজে ছাপা হয়ে গেল। কথা ফেরানোর উপায় রইলো না। ফলে, আমরা পেলাম, 'অপুর সংসার' (১৯৫৯)। আমরা পেলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আমরা পেলাম শর্মিলা ঠাকুর।
'অপরাজিত' এমন একটি মাইল-ফলক; যা শুধু অপু নয়, সত্যজিতেরও চোরা বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করে অজেয় হওয়ার গল্প। 'অপরাজিত' স্রোতের বিপরীতে হেঁটে বিদেশের অকুণ্ঠ প্রশংসা আদায় করে বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমাকে ধন্য করেছিল। আর একগুচ্ছ মানুষের জীবনটাকে আমূল বদলে দিয়েছিল। সত্যজিৎ-এর মতো কালজয়ী স্রষ্টার অধিকাংশ ছবিই এক-একটি মাইল-ফলক; তারই মধ্যে কেবল 'অপরাজিত'র সূত্রেই সত্যজিৎ স্মরণ করে আমরা তাঁকে জানালাম শতবর্ষের শ্রদ্ধা, আমাদের প্রণাম।