আলোয়-কালোয় রামরাম বসু

আঠেরো শতকের শেষদিকে ইংল্যান্ডের খ্রিস্টান মিশনারিদের মধ্যে ভারতবর্ষে খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও প্রসারের ইচ্ছে ব্যাপকভাবে চাগাড় দিল। ইংরেজ-সাম্রাজ্যের শুরু তো এই বাংলা থেকেই, বাংলাতেই তাদের সদর-ঘাঁটি। সুতরাং, জন টমাস নামের এক ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি ধর্মপ্রচারের তাগিদ নিয়ে বাংলায় এলেন। ১৭৮৬-সালে। এটাই তাঁর প্রথম আসা নয়। বছরখানেক আগে একবার এসেছিলেন ঘুরতে। তবে বলা যায়, ধর্মপ্রচারে এলেন প্রথম। তা, বাংলায় এসে তাঁর বেশ কিছুদিন কিন্তু কেটে গেল কলিকাতার ইংরেজ-সমাজের  সঙ্গে পরিচিত হতে হতেই। তাতে আখেরে লাভই হল। আলাপ-আলোচনায় ধীরে ধীরে বুঝলেন স্থানীয় ভাষা বাংলাটি না-শিখলে এখানে ধর্মপ্রচারের গুড়ে বালি! সে না-হয় ইংরেজের জেদে বাংলা ভাষা শিখে নেবেন। কিন্তু, শিখবেনটা কার কাছে! শুরু হল একজন ভালো শিক্ষকের খোঁজ, যিনি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিটাও কাজচালানো গোছের জানেন--এমন কাউকেই তাঁর চাই। কিন্তু, চাই বললেই তো আর পাওয়া যায় না! দিন যায়। টমাসের হতাশা আসে। একদিন কথায় কথায় বন্ধু উইলিয়াম চেম্বাবার্সের কাছে প্রকাশ করেই ফেললেন সেই হতাশা। তাতে উইলিয়াম নড়ে চড়ে বসলেন এবং খুঁচিয়ে টমাসের মুখ থেকে আদ্যপান্ত সব শুনলেন। শুনে এক চিলতে হেসে বললেন, চিন্তা নেই, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।   

কিন্তু, উইলিয়াম আশ্বাস দিলেন কার ভরসায়? আসলে, উইলিয়াম হচ্ছেন একজন ফার্সি দোভাষী। কাজ করেন সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট তখন কলিকাতাতে। এই কোর্টেই এক ফার্সি পণ্ডিত আসেন মুন্সিগিরি করতে, তাঁর নাম, রামরাম বসু। উইলিয়াম জানালেন, লোকটা ফার্সি-বাংলা ভালো জানে; ইংরেজিটাও জানে কাজ চালানো গোছের। সব থেকে বড় কথা, লোকটার আর পাঁচটা দিশি-পণ্ডিতের মতো ইংরেজ সম্পর্কে ভীতি বা নাক সিঁটকানি--কোনটাই নেই। টমাসের মুখ এবার উজ্জ্বল হল, শুধু উজ্জ্বল হল না, তাঁকে দেখে মনে হল যেন তিনি আকাশের চাঁদ পেয়েছেন হাতে! সোৎসাহে বললেন, বাহ, বাহ, বেশ তো! তাহলে এই লোককেই চাই!

 ব্যস, ১৭৮৭ সালের মার্চ মাস থেকে উইলিয়ামের সুপারিশে রামরাম লেগে পড়লেন কাজে। মাইনে ঠিক হল, কুড়ি টাকা। বাঙালির নবজাগরণের ইতিহাসে এভাবেই ঘটে গেল বাবু রামরামের প্রবেশ। তাঁর আগের জীবনের কোন বৃত্তান্ত নেই। বৃত্তান্ত যখন শুরু হল, তখন তাঁর বয়স তেত্রিশ থেকে চৌত্রিশ।

মাস তিন কাটল। টমাস ধর্মযাজক হলেন। তাঁকে মালদা যেতে হল। বোঁচকাবুচকি নিয়ে সফরসঙ্গী হলেন রামরাম। ইতিমধ্যে অবশ্য সাহেবকে তিনি কিছু কিছু বাংলা শিখিয়ে ফেলেছেন। এই সময় গৃহ-শিক্ষকতা ছাড়াও টমাস তাঁকে আর একটা কাজে লাগলেন। সে হল, ধর্মপ্রচার। টমাস ইংরেজিতে যা বলেন, রামরাম বাংলায় তা স্থানীয় মানুষকে বুঝিয়ে খ্রিস্ট-অনুরাগী করে তোলার চেষ্টা করতে লাগলেন। টমাস তাঁর কাজে বেশ খুশি হলেন। 

আসলে, কোর্টে জুতো ঘষতে ঘষতে রামরাম বুঝে নিয়েছেন ইংরেজের মন কেমন করে রাখতে হয়, কেমন করে তাদের কাছ থেকে দু'পয়সা বাগিয়ে নিতে হয়। তিনি পণ্ডিত মানুষ, সেইসঙ্গে বিলক্ষণ ঘোড়েলও! খ্রিস্টান-সকাশে তাঁর হিন্দুয়ানি নিয়ে যাতে প্রশ্ন না-ওঠে, ধর্মের জন্য যাতে মনিবের বিরাগভাজন কখনো না-হন--তার জন্য তাঁর নিরন্তর চালাকির অন্ত রইল না। টমাসের কাছে ভাবখানা এমন করে চলতে লাগলেন যেন খ্রিস্টই তাঁর ধ্যানজ্ঞান এবং অচিরেই তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেবেন--শুধুমাত্র দারাপুত্রপরিবারের বাধায় নিতে পারছেন না, তবে তাদের আখেরে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একদিন ঠিক খ্রিস্টান হবেনই হবেন--এই তাঁর পণ! ইংরেজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে রামরামের জানতে বাকি নেই--কোন ঠাকুরকে কোন ফুলে তুষ্ট করা যায়! টমাসকে ঘেঁটে বুঝলেন লোকটার পেটে সত্যিকার বিদ্যে আছে, কিন্তু বেচারা ধর্ম-পাগল। ফলে, গদগদ ভাব দেখিয়ে একদিন লিখে ফেললেন এক খ্রিস্ট-বন্দনা :

"কে আর তারিতে পারে

             লর্ড জিজছ ক্রাইষ্ট বিনা গো।

পাতক সাগর ঘোর

             লর্ড জিজছ ক্রাইষ্ট বিনা গো।"

টমাস তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে গেলেন এই লেখা পড়ে। ফলে, টমাসের অতি প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে রামরামের দেরি হল না।

বছর চারেক কেটে গেল এভাবে। তারপর টমাস ফিরে গেলেন ইংল্যান্ডে। বছর দুই আবার জুতো-ঘষা কাজে যোগ দিলেন রামরাম। তারপর একদিন হঠাৎ টমাসের ডাক পেলেন। টমাস নাকি আবার বাংলায় ফিরেছেন, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন বন্ধু উইলিয়াম কেরি-কে। রামরাম গিয়ে দেখলেনও তাঁকে। শুনলেন, তিনিও নাকি ধর্মপ্রচার করবেন। আর সেজন্য তাঁকেও বাংলা ভাষা শেখাতে হবে। সুতরাং, রামরাম হাত ফেরতা হয়ে কেরির তাঁবেতে গিয়ে পড়লেন। মাইনে কিন্তু রইল সেই কুড়ি টাকাই।

অল্পদিনেই রামরামের বাকচাতুর্য্য ও পাণ্ডিত্যের যুগল-গুণে কেরি একেবারে মাত হয়ে গেলেন। শিক্ষার এই সময়টায় উপার্জনের জন্য কেরি মদনাবাটির নীলকুঠিতে কাজ নিলেন। কাজেই রামরামও তাঁর সঙ্গী হলেন। কিন্তু, এখানে এসেই মুশকিলটা হল। কিছুদিনের মধ্যেই রামরাম এক যুবতী বিধবার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। ঘনিষ্ঠতা মাত্রা ছাড়াল। মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে গেল। রামরাম জঘন্যভাবে বাচ্চা নষ্ট করে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেবার বিস্তর চেষ্টা করলেন। কিন্তু, গাঁ-গঞ্জের কেচ্ছা তো আর চাপা থাকে না। সেটা গিয়ে উঠল টমাসের কানে। তিনি খোঁজ নিয়ে জানলেন যে, রামরাম একেবারেই ধোয়া তুলসীপাতা নন। সব জেনে টমাস ও কেরি দু'জনেই স্তম্ভিত হলেন, দু'জনেরই বিশ্বাসে দারুণ আঘাত লাগল--তাঁরা এতকাল রামরামকে নিষ্ঠাবান-পবিত্র পণ্ডিত হিসেবেই যে বিশ্বাস করে এসেছেন, তাহলে! সুতরাং, কলঙ্ক-দোষে ও নৈতিকতার দায়ে রামরামের চাকরি গেল। রামরামও বোধহয় খানিক লজ্জিত হয়েই রাতারাতি মদনাবাটি ত্যাগ করলেন।

রামরামকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে কেরির মনটা বেশ খারাপই হল। আসলে, অল্পদিনেই লোকটা মন জিতে নিয়েছিল। তাছাড়া অমন পণ্ডিত, মনোরঞ্জক, বাধ্য লোক পাওয়াও মুশকিল! চরিত্রের দোষই লোকটার কাল হল। কী আর করা!--দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কেরি।

আবার বছর তিন-চার কাটল। রামরামের কোন খোঁজ-খবর নেই। এলো ১৮০০ সাল। কেরি তাঁর ধর্মপ্রচারক বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে শ্রীরামপুরে মিশন গড়ে তুললেন। আর তখনই কোত্থেকে যেন উদয় হলেন রামরাম। নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করে, আর-কোনদিন এরকম ভুল হবে না--শপথ নিয়ে কেরির কাছে কাজ চাইলেন রামরাম। খ্রিস্টধর্মে অনুতাপের গুরুত্ব আছে। অনুতপ্তের জন্য ক্ষমা আছে। সুতরাং, কেরি ক্ষমা করলেন। রামরামকে কাজে বহাল করলেন। আসলে এর ভেতরে একটি পূর্ব-অভিসন্ধিও রইল, কেরি খ্রিস্টধর্মসাহিত্য ও সঙ্গীতের অনুবাদ করে রামরামের সহায়তায় চাইলেন ধর্মপ্রচারের প্রসার ঘটাতে। আর এই সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, বাংলায় খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটাতে গেলে সাধারণ বাঙালির হাতে বাংলাভাষার বাইবেল তুলে দিতে হবে। অবিলম্বে সে-কাজে নিজেই হাত দিলেন। অনুবাদে পদে পদে সাহায্য পেলেন রামরামের। কেরিকে সাহায্য ছাড়াও রামরাম নিজেও কিছু খ্রিস্ট-সঙ্গীত অনুবাদ করলেন। ফলে, তিনি অচিরে আগের মতোই কেরির প্রিয়ভাজন হয়ে উঠলেন।

১৮০০ সালের শেষদিকে আর একটি ঘটনা ঘটল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিভিল-কর্মচারীদের দেশীয় ভাষা-শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলল মোকাম কলিকাতায়, 'ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ'-নামে। তারা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করল, উইলিয়াম কেরি-কে। এবং, কেরির দাক্ষিণ্যে কলেজে  সহশিক্ষক হয়ে এলেন, রামরাম বসু। এখানে তাঁর মাইনে হল, চল্লিশ টাকা।

কলেজ চালাতে এসে কেরি দেখলেন যে, বাংলা ভাষায় পাঠ্য বই-ই তো নেই। গদ্য একেবারেই নেই। ব্যাকরণ নেই। ফলে তড়িঘড়ি কেরি নিজে ব্যাকরণ-রচনার ভার নিয়ে হেড-পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারকে অনুবাদ গদ্য-রচনা ও রামরাম বসুকে মৌলিক গদ্য-রচনার দায়িত্ব দিলেন। মৃত্যুঞ্জয় সংস্কৃত গদ্যসাহিত্যের বিখ্যাত 'বত্রিশ সিংহাসন'-গ্রন্থটি অনুবাদ করলেন। আর রামরাম লিখলেন, যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের জীবনী অবলম্বন করে, 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র'। বইটি ১৮০১ সালের জুলাই মাসে শ্রীরামপুরের মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত হল। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পণ্ডিত বৈদ্যনাথ বইটি মারাঠি ভাষায় অনুবাদ করে ফেললেন কলেজের মারাঠি বিভাগের জন্য। বইটি বাংলা ভাষা ও বাঙালির লেখা প্রথম মৌলিক গদ্যগ্রন্থের মর্যাদা পেল। শুধু তাই নয়, এই কীর্তির জন্য কলেজ-কাউন্সিল থেকে রামরাম তিনশো টাকা পুরস্কারও পেলেন। তাঁর বাংলা গদ্যের বিশিষ্টতা হল : তিনি মৃত্যুঞ্জয়ের মতো সংস্কৃত বাক্যের গঠন ও সন্ধি-সমাস-বাহুল্যতা একেবারেই অনুসরণ করেননি। তিনি ফার্সি বাক্যরীতি অনুসরণ করেছিলেন। ফলে, তা ভাষাকে একদিকে যেমন সুখপাঠ্য করেছিল এবং নতুন রীতির সন্ধান দিয়েছিল। বলতে গেলে, এভাবেই তাঁর হাত ধরে 'লিপিমালা'-র পথ বেয়ে বাংলা গদ্য পূর্ণতার পথে এগিয়ে যাবার গতিমুখ পেল। ১৮১৩ সালের ৭ আগস্ট পর্যন্ত আমৃত্যু তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে শিক্ষকতা করেছেন এবং তা সম্মানের সঙ্গে। পরবর্তীকালে যুগসন্ধির এই লেখককে আলো এবং কালো মিলিয়ে প্রমথনাথ বিশী নায়কের মর্যাদা দিয়েছেন তাঁর 'কেরী সাহেবের মুন্সী' (১৯৫৮) উপন্যাসে। 


তথ্যঋণ : রামরাম বসু-- ব্রজেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...