মানবতার জয়গাথায় রাজশেখর বসু

রাজশেখর বসু সহজ বাংলায় ‘শ্রীমদ্ভাগবদগীতা’, ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ ইত্যাদি হিন্দুধর্মগ্রন্থের অনুবাদ করে গেছেন, তাদের কোন কোন অংশের দার্শনিক ভাষ্যকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ঠিকই; তবুও তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না।

গত শতকের তিনের দশকে এক মর্মান্তিক আঘাত সহ্য করতে হয় তাঁকে। রাজশেখরের সন্তান বলতে ছিলেন একটিমাত্র কন্যা। প্রতিমা। প্রতিমার সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল রাজশেখরের মতোই উদ্যমী, বলিষ্ঠ ও সুদর্শন যুবক অমর পালিতের। কিন্তু বিবাহের কয়েক বছর পর অমর আক্রান্ত হন দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে। রোগে ভুগতে ভুগতে ১৯৩৪ সালে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর শোক সামলাতে না-পেরে ঐ একই দিনে প্রতিমাও মারা যান। কন্যা ও জামাতার এই মৃত্যু পিতার কাছে যে কতবড় শোক, তা সহৃদয় মানুষ মাত্রেই অনুধাবন করতে পারবেন। কিন্তু এই শোকে মুহ্যমান হয়ে কপালের দোহাই দিয়ে রাজশেখর ঈশ্বরের অনুধ্যানে বসেননি। পাটিগণিত ও বীজগণিতের অঙ্ক কষে শোকের বেদনা লাঘব করতে চেয়েছেন।

কন্যা-জামাতার অন্ত্যেষ্টিতে তিনি কী ভূমিকা নিয়েছিলেন জানা যায় না। কিন্তু মৃত্যুর পর যাতে রাজশেখরের মরদেহ হরিধ্বনি দিতে দিতে নিয়ে না-যাওয়া হয়, সে-কথা তিনি শেষ ইচ্ছায় বলে যান। বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে নির্মোহ মন নিয়ে তিনি ঈশ্বর নয়, মানবতাকেই আরাধ্য বলে গ্রহণ করে সারাটা জীবন কাটিয়ে গেছেন। সেই মানবতার কল্যাণের জন্যই জগদীশচন্দ্র বসুর ছাত্র প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্নেহধন্য এই মানুষটি বিজ্ঞানের সাধনা করে গেছেন। বেঙ্গল কেমিক্যালকেই তাঁর সাধনভূমি জ্ঞানে আগলে রেখে সমৃদ্ধ করে গেছেন। স্বদেশি সাবান, স্বদেশি সুগন্ধী, ওষুধ, সিরাপ, ভেসলিন প্রভৃতি তৈরি করে স্বদেশবাসীকে স্বাবলম্বী করতে চেয়েছেন।

শোনা যায়, তিনি মাত্র বার বছর বয়সে মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে নিরামিষাশী হয়েছিলেন। তারপর সারা জীবনেও আর আমিষ ধরেননি। না, এর মূলেও কোন ঈশ্বরভাবনা কোনদিনই ছিল না। আসলে, জ্ঞানগম্যি হওয়ার পর থেকে তিনি পশুপাখি প্রভৃতি মনুষ্যেতর প্রাণিদের মেরে খাবার কথা ভাবতেও পারতেন না। বাড়ির লোকের পাতা কলে ইঁদুর পড়লে ছেড়ে দিতেন। অসুস্থ কুকুর-বেড়ালকে গৃহে আশ্রয় দিতেন। বাবার উত্তরাধিকারে বাড়িতে তাঁদের একখানা পাখিমারা বন্দুক ছিল বটে, কিন্তু তা একবার গাছের ডাবের দিকে তাক করা ছাড়া আর কোনদিন ব্যবহার করেননি।

RAJSHEKHAR-001

জীবনচর্যায় অহিংস হলেও রাজনৈতিক ভাবনায় তিনি কিন্তু অহিংস ছিলেন না। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবীদের কার্যকলাপকে তিনি সমর্থন করতেন। শোনা যায়, অগ্নিযুগে বিপ্লবীদের গোপনে টাকা–পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। মানিকতলায় বিপ্লবীদের অনুশীলন সমিতির যে আড্ডাটি ছিল, তার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। বিপ্লবীদের বোমা তৈরির মালমশলা দিয়ে সাহায্য করতেন। এখন ব্যক্তিজীবন ও রাজনৈতিক ভাবনায় তাঁর এই যে বিপ্রতীপতা, এর কারণটা কী? উত্তর রাজশেখরই দিয়েছেন। ভূপেন্দ্রচন্দ্র সিংহের ‘বন-জঙ্গল ও শিকারের কথা’ বইটিতে রাজশেখরের লেখা ভূমিকায় প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেনঃ

‘আত্মরক্ষা, স্বজনরক্ষা আর দেশরক্ষার প্রয়োজনে হিংস্র হতে হয়। যখন দরকার হবে তখন হিংস্র হব—শুধু এই সংকল্প করলে চলে না, আগে থেকে অস্ত্রের প্রয়োগ অভ্যাস করতে হয়।’

অর্থাৎ, রাজশেখর আচারে অহিংস, বাস্তব প্রয়োজনে হিংসার সমর্থক, তথাকথিত ধর্মভাবনায় নিরীশ্বর; কিন্তু মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ। তাঁর দায় মানবতার প্রতি। তাই তাঁর কাছে কেউ হাত পেতে এসে দাঁড়ালে খালি হাতে সে ফিরে যেত না, যত কষ্টই হোক যথার্থ প্রয়োজন থাকলে তিনি তার প্রার্থনা পূরণ করতেন। 

শোনা যায়, রাজশেখর গোপনে অনেক দানধ্যান করতেন, অনেক প্রতিষ্ঠানে সাহায্য করতেন নিয়মিত। তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী চাপা স্বভাবের মানুষ, তাই সেই সব কর্মকাণ্ডের বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যায় না। ডান হাত দান করলে, বাঁ-হাত টের পাবে না—তিনি ছিলেন এই নীতিতে বিশ্বাসী। তবুও কিছু কিছু কাজের কথা অন্যের স্মৃতি থেকে জানা যায়। তারই একটি হল, মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্র।

আসলে, মনোবিদ্যার চর্চার জন্য রাজশেখরের ভাই গিরীন্দ্রশেখর ১৯২২ সালে ‘ইন্ডিয়ান সাইকো এ্যনালেটিক্যাল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। সোসাইটির সঙ্গে রাজশেখর প্রথম থেকেই জড়িত ছিলেন। কিছুকাল পরে এঁদের মাধ্যমে বিনামূল্যে মানসিক রুগির চিকিৎসার জন্য তিলজলার বেদেডাঙা রোডে জমি কিনে একটি হাসপাতাল তৈরি করে দেন। এছাড়া এই হাসপাতালের আউটডোরে সাধারণ রোগ-অসুখের চিকিৎসার জন্যও বিনামূল্যের ওষুধের ব্যবস্থা করে দেন বেঙ্গল কেমিক্যালের আনুকূল্যে।

মানবতার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থার জন্যই রাজশেখরের মনে ছিল সকলের প্রতি সমান সহানুভূতি। তিনি কোন সাহিত্যগোষ্ঠী বা দলাদলির মধ্যে ছিলেন না কোনদিন। কারও প্রতি কোন নিন্দা তাঁর মুখ থেকে কেউ কোনদিন শোনেননি। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বরং সকলেই পেয়েছেন তাঁর সহানুভূতিশীল মনটির পরিচয়।

তখন রাজশেখর বেশ বৃদ্ধ। তাঁর ‘চলন্তিকা’ অভিধান অত্যন্ত জনপ্রিয়। একই সময়ে আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধিও একখানা অভিধান রচনা করেন। কিন্তু অর্থের অভাবে তিনি তা পুনঃপ্রকাশ করতে পারছেন না। ছিয়ানব্বই বছর বয়সী বিদ্যানিধিমশাই রাজশেখরকে এই ব্যাপারে একদিন তাঁর মনের কষ্টের কথা জানালেন।

CHALANTIKA (1)

অন্য মনের মানুষ হলে, অন্য অভিধানকার হলে, সাহিত্য জগতের প্রথাগত ঈর্ষা অন্তরে লালন করলে বিদ্যানিধির কথাকে পাত্তাই দিতেন না রাজশেখর। কিন্তু তিনি অন্য ধাতুতে গড়া। তাই গভীর সহানুভূতিতে তাঁর কথা মনে রাখলেন। ক’দিন পর প্রকাশক সুধীরচন্দ্র সরকার ‘চলন্তিকা’র নতুন সংস্করণের জন্য সাক্ষাৎ করতে এলে তাঁকে বিদ্যানিধির কথা বলে যাতে তাঁর অভিধানটি পুনঃপ্রকাশ করা যায়, তার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন।

মানুষের প্রতি এই দায়বদ্ধতাই রাজশেখর ‘পরশুরাম’কে স্যাটায়ারের পরশু ধরতে প্রাণিত করেছিল। সমাজ-সংসার, রাজনীতি ও অর্থনীতির অমানবিক দিকগুলোকে ব্যঙ্গের কষাঘাতে আহত করে মানবতার জয়ধ্বজা ওড়াতে প্রাণিত করেছিল। এ কাজে তিনি সফল হয়েছিলেন বলেই কালের কষ্টিপাথরে সাহিত্যিক হিসেবে পরশুরাম রয়ে গেছেন, রয়ে গেছে তাঁর সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যে নিছক ছোটগল্প লিখে অমর হওয়ার কৃতিত্ব তাঁর আগে বা পরের কারও নেই। বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের রূপকার রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত কালের জয়ধ্বনি শুনতে গানের ওপর আস্থা রাখতে হয়েছে; কিন্তু রাজশেখরকে হয়নি। মানবতা ও সাহিত্যগুণের সমন্বয়ে এ এক বিরল দৃষ্টান্ত…

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...