রাহুল দেব বর্মণ অর্থাৎ পঞ্চম যখন কলকাতায় ঠাকুমার কাছে থেকে স্কুলে পড়াশুনো করছেন; তখন বম্বেবাসী শচীন দেব বর্মণ অসম্ভব জনপ্রিয় ও ব্যস্ত সঙ্গীত পরিচালক। কালেভদ্রে কলকাতায় আসেন, এক যাত্রায় পৃথক ফল--রেকর্ডের কাজও হয়, আবার ছেলের সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়।
সে-বার কলকাতায় এলেন বিশেষ একটা কাজে--ছেলেরই স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে চিফ গেস্ট হয়ে। পঞ্চম স্পোর্টসে খুবই ভালো। সাইক্লিং-এ কিছু একটা হলেন। অন্যান্য খেলার বিজয়ী ছেলেদের সঙ্গে নিজের ছেলের হাতেও পুরস্কার তুলে দিলেন শচীন দেব। কিন্তু, অবাক হলেন সন্ধেবেলায়। ছেলেকে মাইথঅর্গ্যান বাজাতে দেখে! ছেলে যে তলে তলে এসব শিখছে এ তো তাঁর জানা ছিল না! আর কী ভালো বাজাল, তাঁকেও আবিষ্ট করে ছাড়ল!
পরদিন সকালেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, কদ্দিন চলছে এসব শেখা? পঞ্চম বললেন, আট মাস। বাবা বললেন, হুম। তা, এসব শিখে কী হতে চাও, মিউজিশিয়ান? বালক পঞ্চম সরলভাবে মাথা নাড়লেন, না, তোমার চেয়েও বড় মিউজিক ডিরেক্টার! ছেলের কথায় এমন একটা প্রত্যয় ছিল যে, বাবা একইসঙ্গে চমকিত হলেন এবং খুশিও হলেন। বুঝলেন, ছেলেটি তাঁর কাদার তালের মতো কুমোরের চাকায় প্রস্তুত, শুধু তার শিল্পসত্তাটাকে আকার দিতে হবে।
কাজেই, শচীনদেব পঞ্চমকে তালে-লয়ে পটু করে তুলতে বিখ্যাত তবলিয়া ব্রজেন বিশ্বাস মশায়ের কাছে পাঠিয়ে তবলা শেখালেন। তারপর সরোদ শেখালেন আলী আকবর খাঁ সাহেব এবং আশিস খাঁ সাহেবের কাছে। বললেন, মিউজিক কম্পোজার হতে গেলে কোন ইন্সট্রুমেন্টের কতটা রেঞ্জ--এসব জানতেই হবে। বাবার কথামতো পঞ্চম চার বছর ধরে নানারকম মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট শিখলেন; সেইসঙ্গে আত্মস্থ করলেন ক্লাসিক্যাল মিউজিক।
পড়াশুনোয় পঞ্চম কোনদিনই ভালো ছিলেন না। তার ওপর এই চার বছরে সে একেবারে ডকে উঠল। তাই শচীন দেব সে-বার কলকাতায় আসতেই ঠাকুমা একেবারে চোদ্দ কাহন শুনিয়ে ছাড়লেন--ছাইপাঁশ সবই হচ্ছে, শুধু কাজের কাজটাই হচ্ছে না! তখন শচীন দেব বললেন--বেশ, পড়াশুনা যখন হচ্ছে না, তখন আমার সঙ্গেই বম্বে চলুক। আমারও বয়স হচ্ছে। দশটা বছর পেলে ওকে তৈরি করে নিতে পারব, ও-ও কিছু করে নিতে পারবে। কিন্তু, এই কথা যেই না বলা অমনি ঠাকুমা ফায়ার--হ্যাঁ, নিয়ে যাওয়াচ্ছি! এই বয়সে বম্বের বায়োস্কোপে ঢুকে উচ্ছন্নে যাক আর কী! তোমরা তো তাই চাও! সেই জন্যে বুঝি এতদিন বুকে আগলে মানুষ করলুম! আমি বেঁচে থাকতে সেটি হতে দিচ্ছি না!--সুতরাং, শুরু হল বখেড়া! মা-ছেলেতে খানিক চেঁচামেচি চলল। বলাবাহুল্য, শচীন দেব মায়ের কাছে হেরে গেলেন। কিশোর পঞ্চমের বম্বে যাবার আশায় জল পড়ল। গোমড়া মুখে একা শচীন দেবের বম্বে ফেরার পালা। তবে, যাবার আগে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন--নতুন সুরটুর বানিয়েছিস নাকি কিছু? এসব ব্যাপারে পঞ্চম সবসময় তৈরি। বললেন, হ্যাঁ। বাবা বললেন, শোনাতে পারবি?--নিশ্চয়, সে আর এমন কী! শুনিয়ে দিলেন পঞ্চম, একেবারে খান পনের টিউন। বাবা চলে গেলেন।
পরের বছর রিলিজ করল বাবার পরিচালনায় 'ফান্টুস' ছবির গানের রেকর্ড। রেকর্ড চালিয়ে গান শুনতে গিয়েই পঞ্চমের চোখ একেবারে ছানাবড়া! আরে, 'আ মেরি টোপি পলটকে আ'-গানটার সুর তো তাঁরই পনেরটা টিউনের একটা! বাবা আসতেই পঞ্চম তাঁকে ছেঁকে ধরলেন--না বলে, তুমি আমার টিউন কেন নিয়েছ, বলো! ছেলের অভিযোগের উত্তরে শচীন দেবের মুখে কেবল ছোট্ট এক টুকরো হাসি। সেই হাসি বলে দিচ্ছিল--নিজের নামে না হোক, তোমার টিউন ভারতীয় সিনেমায় এন্ট্রি পেয়ে গেছে বাপ, এবার তোমার এন্ট্রি শুধু সময়ের অপেক্ষা!
তারপর কেটে গেল দিনের পরে দিন...
পাঁচের দশকের মাঝামাঝি। নিজেই বম্বে আসার সুযোগ করে নিলেন পঞ্চম। আসলে, ঠাকুমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়েও বম্বে আসার কোন ছুঁতো পাচ্ছিলেন না তিনি। এমনসময় বাবার বন্ধু গুরু দত্ত কলকাতায় এলেন। তিনি তাঁর 'পিয়াসা' ছবির শ্যুটিং করবেন কলকাতায়, তাই লোকেশন দেখতে এসেছেন। শচীন দেব এই ছবির সঙ্গীত পরিচালক। এসব খবর জেনে গুরু দত্তের কাছে পঞ্চম এমন ঝুলোঝুলি করলেন যে, একেবারে কাজ জুটিয়ে বম্বে হাজির হয়ে তবে হাঁপ ছাড়লেন। 'পিয়াসা' ছবিতে পঞ্চম শুধুই যে বাবার সহকারী হলেন তা নয়, একটি গানে নিজে সুর দিলেন, এমনকি মাউথঅর্গ্যানও বাজালেন।
পঞ্চম এতদিনে বাবার সান্নিধ্য ও সাহচর্য পেয়ে সঙ্গীত পরিচালনার খুঁটিনাটি ও ব্যবসায়িক দিকগুলো জানার সুযোগ পেলেন। কী করে প্রযোজক-পরিচালকের পছন্দ বুঝে নিয়ে গান তৈরি করা যায়; সিচুয়েশন শুনে ঝটপট ভিসুয়ালাইজ করে কীভাবে গান তৈরি করতে হয়; পাখির ডাক, নয়েজ, গাড়ির হর্ণ--এসব থেকেও কীভাবে সুর খুঁজে নিতে হয়--এসবই বাবা হাতে ধরে তাঁকে শেখালেন। আবার, একজন মিউজিক ডিরেক্টার কীভাবে গানকে আরও নাটকীয় করে তোলেন তাও শেখালেন 'ট্যাক্সি ড্রাইভার'-ছবির কাজ করতে গিয়ে। এই ছবির 'ছোড় দো আঁচল'-গানটিতে শচীন দেব শুরুতে একটা 'আ:' যোগ করলেন। যেখানে নায়ক নায়িকাকে বিরক্ত করছে, সেখানে এই 'আ:' যেন নায়িকার রিয়েকশন হয়ে গেল। নাটক তৈরি হল। এবং, গানের মেজাজটাই পাল্টে গেল।
সহকারীদের ভবিষ্যতের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে গড়ে তোলার একটা দারুণ পদ্ধতি ছিল শচীন দেবের। তিনি হয়ত গানের মুখড়া বানালেন; কিন্তু, অন্তরা বানাবার ভার দিলেন তাঁর তিন সহকারী--জয়দেব ভার্মা, সুরিত কাউর এবং পঞ্চমকে। বলে দিলেন, যারটা ভালো হবে, তারটা নেবেন। ফলে, তিনজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত কে কত ভালো করতে পারে! এভাবেই তিনি প্রত্যেকের মনে তৈরি করে দিতেন ভালো কাজের প্রবণতা। অন্তরা তৈরি হলে শোনানো হতো বাড়ির কাজের লোককে। তার ভালো লাগা, মন্দ লাগার ওপরেই নির্ভর করত প্রতিযোগীদের সৃষ্টির ভবিষ্যৎ। কারণ, এরাই সেই শ্রোতাদের প্রতিনিধি, যাদের জন্য গান হিট হতো, এখনও হয়। শচীন দেব তাই বলতেন, গান হবে, 'সিম্পল এন্ড বিউটিফুল'--যাতে সাধারণের মন ছুঁয়ে যায়। আর এই গুণপনার জন্যই হয়ত অন্তরা নির্মাণের প্রতিযোগিতায় বেশিরভাগ সময় পঞ্চমই জিততেন।
সুর পঞ্চমের মজ্জায় এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিল যে, মাঝেমাঝেই সুরের রামধনু তাঁর স্বপ্নে এসে ধরা দিত। 'কাঞ্চি রে কাঞ্চি রে', 'তুম বিন জাউঁ কাঁহা', 'দুনিয়া মে লোগোকো'--র মতো কালজয়ী গানের সুর তাঁর সেই স্বপ্নলব্ধ ধন।
দিন এভাবেই কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু তারই মধ্যে একদিন সাধারণ সহকারী থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক ডিরেক্টার হওয়ার সুযোগ এল হঠাৎ-ই। আর এই সুযোগ দিতে চাইলেন গুরু দত্ত। তিনি 'রাজ'-নামের একটি ছবি করছেন। প্রজেক্ট হিসেবে কাজটা তেমন কিছু নয়। তাই, এই কাজটা দিয়ে পঞ্চমের স্বাধীন কেরিয়ার শুরু হোক--শচীন দেব চাইছিলেন না। তাঁর মতে, শুরু করতে হলে একটা ভালো প্রজেক্ট দিয়ে শুরু করা উচিত। তবু, সাতপাঁচ ভেবে পঞ্চম কাজটা নিলেন। আর কিছু না-হোক, একটা এক্সপিরিয়েন্স তো হবে। যাইহোক, গুরু দত্ত একদিন টিউন শুনতে এলেন। পঞ্চম শোনালেন। পছন্দ হল না। মুখের ওপর বলে দিলেন--'সরি, আপনেকো জম নেহি রাহা!' প্রথম ছবিতেই মুখের ওপর এমন কথা শুনে দারুণ হতাশ হলেন পঞ্চম। প্রজেক্ট থেকে তাঁকে বাদ দিয়ে দেওয়া হল। দারুণ অপমানিত হয়ে ভেঙে পড়ার সেই মুহূর্তে দুটো অবলম্বন তাঁকে বাঁচিয়ে দিল। বাবার সাহচর্য এবং বন্ধু মেহমুদের সান্ত্বনার স্পর্শ। মেহমুদ সব শুনে বন্ধুর অপমান মুছে ফেলতে শুধু সান্ত্বনার হাতই বাড়ালেন না, গুরু দত্ত যে টিউনটি বাতিল করেছেন, তা দিয়ে 'ঘর আজা' গানটি তৈরি করিয়ে ব্যবহার করলেন তাঁর 'ছোটে নবাব' ছবিতে।
মেহমুদ যেন পঞ্চমের জীবনে সৌভাগ্যের সূত্র এগিয়ে দিলেন। কেননা, তারপরই এল একটা ভালো কাজের সুযোগ। নাসির হুসেন 'তিসরি মঞ্জিল'-নামে একটি ছবি প্রযোজনা করবেন। এ-ছবির জন্য তিনি একজন নতুন মিউজিক ডিরেক্টার চাইছিলেন। গীতিকার মজরুহ সুলতানপুরীকে সেকথা বলতেই, তিনি সাজেস্ট করলেন পঞ্চমের নাম। কথাবার্তা পাকা হল। কিন্তু, তারপরই মুশকিল হয়ে গেল--ছবিতে নায়ক হিসেবে দেবানন্দের কাজ করার কথা ছিলছিল, কিন্তু, হঠাৎ করে সব হিসেব এলোমেলো করে সে জায়গায় এলেন শাম্মী কাপুর। তাঁর আবার প্রিয় মিউজিক ডিরেক্টার আছেন, তাঁরা শঙ্কর-জয়কিষণ জুটি। তিনি এতদিন এঁদের সঙ্গেই কাজ করেছেন, এখানেও তাই করতে চান। তাঁরা তাঁর পালস বোঝেন। একজন সুপারস্টার হিসেবে তিনি নতুন কারও সঙ্গে কাজ করার রিস্ক নিতে পারবেন না! এ তো মহামুস্কিল হল! এদিকে পঞ্চমের সঙ্গে পাকা কথা হয়ে গেছে, তিনি দেড়শখানা টিউন বানিয়ে বসে আছেন--এই পরিস্থিতিতে তাঁর সঙ্গে নাসির হুসেন কথার খেলাপ করেন কেমন করে! শাম্মীকেই কোনভাবে রাজি করাতে হবে। নাসির তাঁকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বললেন, ছেলেটা অনেক আশা নিয়ে আছে। একবার শুনেই দেখ না, পছন্দ না-হলে তখন না-হয় শঙ্কর-জয়কিষণকে ডাকা যাবে।
নাসির হুসেনের মতো দামী প্রযোজকের কথা তো আর ফেলা যায় না। তাই তাঁর মন রাখতে শাম্মী রাজি হলেন এবং নাসিরের সঙ্গে এলেন টিউন শুনতে। অবজ্ঞার সুরেই বললেন, শোনাও কী বানিয়েছ। শুধু শুধু সময় নষ্ট...শেষ পর্যন্ত সেই শঙ্কর-জয়কিষণকেই তো ডাকতে হবে! যাক গে, শোনাও...
পঞ্চম অপমান গায়ে মাখলেন না। শোনাতে শুরু করলেন তাঁর ভাণ্ডারের অমূল্য রত্ন। সামনে শাম্মীর ভাবলেশহীন মুখ, সেই মুখ দেখে সে মুগ্ধ না ক্ষুব্ধ--কিছুই বোঝার উপায় নেই। 'দিওয়ানা মুঝসা নেহি', 'ও হাসিনা', 'ও মেরে সোনা রে সোনা', 'আজা আজা'--পর পর এই চারখানা গানের সুর শুনেই উঠে পড়লেন শাম্মী। কি হল, এত ভালো টিউন পছন্দ হল না! নাসির এবং পঞ্চম দুজনেই স্তব্ধ, দুজনেই হতাশ। নিস্তব্ধতা ভেঙে কথা বললেন শাম্মী। বললেন নাসিরকে--চাইলে তুমি বসে বসে দেড়শখানা টিউন শুনতে পারো, আমার আর শোনার দরকার নেই। এই ছবি থেকেই পঞ্চম হবে আমার মিউজিক ডিরেক্টার!
'তিসরি মঞ্জিল'-এর সব গান হিট হল। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে পঞ্চমের খুব নাম হল। কিন্তু, কাজ এলো না। ফলে, আবার ফিরতে হল পুরোনো পেশায়--আবার, বাবার সহকারী। তবে, ভাগ্যের চাকা বোধহয় ঘুরল 'আরাধনা' ছবিতে কাজ করতে গিয়ে। আলাপ হল পরিচালক শক্তি সামন্তর সঙ্গে। বন্ধুত্বও হল। তিনি হিরের আলো দেখতে পেলেন। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে পঞ্চমকে নিলেন, তাঁর পরের ছবি 'কাটি পতঙ্গ'-এ। ব্যস, গানে-গল্পে ছবিটা মাইলস্টোন হয়ে গেল। জনপ্রিয়তা এমন হল যে, পরবর্তী এক দশক আর পঞ্চমকে পিছন ফিরে তাকাতে হল না। ছেলের এই সাফল্য উপভোগ করলেন এবং তৃপ্ত হলেন শচীন দেব। যাক এতদিনে, যে কাদার তালটিকে তিনি শিল্পের আধার করে তুলেছিলেন, তা মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারল তাহলে! শচীন দেব প্রতিদিন জুহু বিচে মর্নিংওয়াক করতে যেতেন। একদিন ফিরে পঞ্চমকে বললেন, "Today I am very happy with you. Till now I was recognised as S.D Burman but today someone pointed me out and said--There goes R.D Burman's father." আহা, শিল্পীজীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী-ই বা হতে পারে!
তথ্যসূত্র : Filmfare, 16 June, 1984