কত্থক সম্রাট

পায়ে বাঁধা ঘুঙরু। ছন্দে ছন্দে এগিয়ে চলছে পা। কিন্তু ঘুঙরু চুপ। ঘুঙরু তখনই কথা বলবে যখন তিনি চাইবেন। কখনও মনোহরণ শ্যামের ভাষায়। কখনও কথা বলে উঠছে রাইকিশোরী। পূর্বরাগ, অনুরাগ, মাথুরের ভাষায়। তাল আর ঘুঙরুর সঙ্গম ঘটছে তাঁর পায়ের ছন্দে। ঘুঙুরের বোলে। ঘুঙরু যে কথা বলত তাঁর ভাষায়! বাকহারা হয়ে যেত দর্শক!

মঞ্চ আলো করে শ্যামকুঞ্জ সাজাতেন বিরজু মহারাজ। দর্শকদের সাধ্য কী অন্য দিকে মন যায়! তিনি এমনই। পুরো নাম ব্রিজমোহন নাথ মিশ্র। কিন্তু সেই নাম কবেই হারিয়ে গিয়েছে। নাচ জগতে তিনি শুধুই ‘বিরজু মহারাজ’কত্থক সম্রাট১৯৩৮ সালে তাঁর জন্ম। বিখ্যাত মহারাজ পরিবারে। লাচু মহারাজা, শম্ভু মহারাজ তাঁর কাকা। বাবা অচন মহারাজ। সকলেই নৃত্যশিল্পী। কত্থকে নিবেদিত প্রাণ।

লখনউয়ের বিখ্যাত বিন্দাদিন ঘরানার উত্তরাধিকার বহন করতেন। তাঁর নিজের কথায় পিতামহ বিন্দাদিন মহারাজ নিজেই পাঁচ হাজারের বেশি ঠুমরী ভজন লিখেছিলেন।

 

BirjuMaharaj1

 

ছোটবেলায় বিরজুর নাচের সূচনাই হয়েছিল বাবার কাছে। বাবাই প্রথম গুরু। বয়স তখন মাত্র সাত।  কিন্তু বাবাকে খুব বেশি দিন পাননি। খুব অল্প বয়সে বাবাকে হারাতে হয়। কিন্তু শোকের বেগে সাধনার পথ ভেসে যায় না। সেখানে মহীরুহ হয়ে আগল দিয়েছিলেন তাঁর মা। সে লাচচু মহারাজ তাঁকে টেলিফোনে ডাক পাঠাতেন, “চলে এসো…বোম্বাই…” অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব থাকত সেই বার্তায়। গাড়ি-বাড়ির প্রলোভন। পথ হারাননি তিনি। মা তাঁকে পথ দেখিয়েছিলেন।

নাচ তাঁর কাছে ছিল ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ পথ। দেবালয় থেকে রুপালী পর্দার দুনিয়া তাল-ছন্দ-মূর্ছনাকে কোনওদিন আলাদা আলাদা ভাবে দেখেননি। তার জোরে বদলে দিয়েছিলেন বলিউডের কোরিওগ্রাফির ধারাকে। চূড়ান্ত বানিজ্যিক ছবিতেও মিশেছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের সুষমা। মধুবালা থেকে মাধুরী এভাবেই… বলিউডে তাঁর কনিষ্ঠতম ছাত্রীর নাম আলিয়া ভাট। ‘কলঙ্ক’ ছবিতে ‘ঘর মোরে পরদেশিয়া’ গানের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তবে তাঁর সেরা ছাত্রীর নাম সব সময় ‘মাধুরী’

 

BirjuMaharaj2

 

১৯৯৭-তে ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ ছবির জন্য প্রথম তাঁর কাছে এসেছিলেন মাধুরী। এক সিকোয়েন্সে শাহরুখের ড্রামের সঙ্গে পারফর্ম করবেন মাধুরী। ড্রামের প্রতিটা বিট ধরে ধরে শিখিয়েছিলেন।

পরবর্তী সময়ে সঞ্জয়লীলা বনশালির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন।  ‘কাহে ছেড়ে’, ‘মোহে রং দে লাল’, এমন অনেক। সঞ্জয়ের নান্দনিকবোধ তাঁকে মুগ্ধ করত। ওড়িশি নৃত্যে পরিচালকের জ্ঞান আর আগ্রহ ছবিতে কাজ করতে এ করকম আরাম দিত। বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল চমৎকার। তাই জুটি বাঁধতে সময় লাগেনি।

কত্থকের মায়েস্ত্রো গাইতে পারতেন ভীষণ ভালো। বাজাতেও পারতেন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন। তাই সাম্প্রতিক ওটিটি জমানার ট্রেন্ডকেও আপন করে নিয়েছিলেন। সম্প্রতি কাজ করছিলেন ‘হীরামান্ডি’ নামে এক ওয়েবসিরিজে। ছোট্ট ডান্স সিক্যুইয়েন্স। তবু তিনি যে ‘বিরজু মহারাজ’! ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মেলবন্ধনের পাঠই শিখে গিয়েছেন আজীবন…নিজের দর্শন দিয়ে। অন্যথা হয়নি কখনও…

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...