প্রেক্ষাপট কলকাতা। চল্লিশের দশক। উত্তাল সময়ের মধ্যে দিন-রাত পার করছে মহানগরী। সময়ের অস্থিরতা ছাপ ফেলেছে তার প্রতিদিনের বেঁচে থাকায়। গনগনে রাজনীতির আবর্তে পাক খাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌবন। শিক্ষা থেকে কর্মক্ষেত্র সব জায়গাই অনিশ্চয়তার মেঘে। আর তার মধ্যে আটকে গিয়েছে এক ‘হাফ-রিপোর্টার’-এর জীবন। গলি থেকে রাজপথে পৌঁছাবার রাস্তাটা বড্ড ঘোলাটে। একদিন যেন আপনা থেকেই জটগুলো খুলতে শুরু করল। নতুন উড়ানে পাড়ি দিয়ে জীবন পৌঁছল রাজধানী শহরের মাটিতে। রসদ এক অনুঘটক।
পুরো উপন্যাসটি চিঠির আকারে লেখা। চরিত্র মাত্র দুজন।বাচ্চু আর মেমসাহেব।
তাদের ঘিরেই আবর্তিত হয় গল্প। রগচটা সময়ে রোমান্টিক কাহিনী যে উপন্যাস শেষ হয় চূড়ান্ত ট্র্যাজেডিতে। বাচ্চু আর মেমসাহেব-এর জীবন এক বিন্দুতে মিলে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে নন্দিনীর মৃত্যু ছিঁড়েখুড়ে একাকার করে দিয়েছিল পাঠকের মনকে।
চরিত্র শুধুমাত্র বাচ্চুর ‘মেমসাহেব’ হয়ে থাকেনি পুরুষ চরিত্র নির্ভর বাংলা সাহিত্যে সার্বজনীন হয়ে উঠেছিল টানটান স্পর্ধায়।
প্রেম, রাজনীতি আর সমকাল মিশে পেয়েছে সফল হওয়ার মর্যাদা। লেখকের কাছে বারবার প্রশ্ন আসত ‘ মেমসাহেব আসলে কে’। তাঁকে বাঙালি চিনেছিল-ই ‘মেমসাহেবে’র লেখক হিসেবে। শুধুমাত্র বিদগ্ধ পাঠকমহল নয়, একেবারে ঘরে ঘরে।
নিমাই ভট্টাচার্য। উপন্যাসের নায়ক ‘বাচ্চু’র জীবনযুদ্ধের গল্প যেন মিলেমিশে যায় লেখকের জীবনের সঙ্গে। সাধারণ পাঠকের কৌতুহলের মুখে পড়েন লেখক। ‘মেমসাহেব কে’- প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, “...পাঠক সমাজ ভেবে নিক। তবে মেমসাহেব চরিত্রটি একেবারেই কাল্পনিক ।”
নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার শালিখা থানায় ১০ এপ্রিল ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন সাংবাদিক হিসেবেই।১৯৬৩ সালে প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায়। ব্যাপক সমাদর পেয়েছিলেন পাঠকমহলে।
কিন্তু তাঁর কর্মজীবনের অনেকটাই কেটেছে রাজধানী শহরে। রাজনৈতিক কূটনৈতিক সংসদীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতেন। ক্ষমতার অলিন্দে থাকা মানুষদের সস্নেহ-সাহচর্য পেয়েছেন। ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাস বদলে দেওয়া ঘটনা, টানাপড়েন, পালা-বদল দেখেছেন সামনে থেকে।
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন, পণ্ডিত জহর লাল নেহরু, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধীর সফর সঙ্গী হয়েছেন সাংবাদিক হিসেবে। এসেছেন বিদেশি রাষ্ট্রদূত এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের সাহচর্যেও।
পেশাগত জীবনের দেখা মিলে গিয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত সাহিত্যিক জীবনেও। ছাপ পড়েছিল প্রত্যক্ষভাবে। যদিও নিমাই ভট্টাচার্যের নিজের ভাষায়, রিপোর্টিং জীবন এবং সাহিত্যিক জীবন দুই-ই একেবারে ভিন্ন খাতে বয়।
তবে সাংবাদিকের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ক্ষমতা উপন্যাসের চেনা ছককে ভেঙে দিয়েছিল।
প্রতিবেদনের কেঠো-কেজো রিপোর্ট লেখার ফাঁকে ফাঁকে লিখতেন উপন্যাস । ১৯৮০ সালের পর পুরোপুরি লেখক জীবনে প্রবেশ করেন। স্বাধীনভাবে লেখালিখি। দেড়শোর ওপর বই লিখেছেন। বেশিরভাগই উপন্যাস। তাঁর লেখায় শুধু জীবন নয় দেশ, সময় আর সমাজ একইভাবে উঠে এসেছে। হয়ে উঠেছে দলিল। সেখানেই লেখক জীবনের স্বার্থকতা।
শেষ জীবনের অসুস্থতা কলম কেড়েছিল, কিন্তু মন থেকে হারিয়ে যায়নি লেখার জন্য ছটফটানিটা। সৃষ্টিশীল মানুষের গুপ্ত হাতিয়ার ‘অতৃপ্তি’ হয়েছিল তাঁর আজীবনের সঙ্গী। তা থেকে বেরতে চাননি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
"Time marches on but memories stays, Torturing silently the rest of our days."