"রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন/ পঁচিশে বৈশাখ/ সেই দিনে না হোক, সেই তারিখে/ আমারো জন্মে বেজেছিল শাঁখ/ পঁচিশে বৈশাখ"।
নিজের জন্মদিনকে উপলক্ষ করে এমনটি লিখেছিলেন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন সঙ্গীতশিল্পী পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। ১৯০৯ সালের মে মাসের ৮ তারিখে মধ্য কলকাতার ৩৮ নম্বর ক্রিক রো-তে তাঁর জন্ম।
তাঁর বাবা কিরণচন্দ্র ঘোষ ও মা নলিনী দেবী।মিশনারী স্কুল কলিন্স ইনস্টিটিউশনে স্কুলজীবন। স্কুলে গানবাজনা বিশেষ হত না।বাড়িতে গাওয়া হত ব্রহ্মসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ঠাকুর্দা দ্বারকানাথ ঘোষ ছিলেন ডোয়ার্কিনের হারমোনিয়ামের রূপকার। ডোয়ার্কিনের দোকানে নানা ধরণের যন্ত্র থাকত।
"আমরাও যখন তখন ক্ল্যারিওনেট, কর্নেট প্রভৃতি যন্ত্র উঠিয়ে আনতাম-বাড়িতে পিয়ানো – অর্গ্যান তো ছিলই। আমরা সেইসব যন্ত্র বাজাবার চেষ্টা করতাম বাড়িতে"। তখনও তিনি স্কুলের ছাত্র। "বাড়িতে নিজেদের অর্কেস্ট্রা তৈরি হল। বড়দা খুব ভালো গাইতে পারতেন। দাদা তৈরি করতেন নতুন নতুন গৎ। বেহালা, তবলা, ঢোল এগুলি বাজাতাম আমি"।
কী করে এসব যন্ত্র তিনি বাজাতে শিখেছিলেন? "আমার ছোটবেলাতেই ঠাকুর্দা আমার জন্য একজন তবলার শিক্ষক ঠিক করে দিয়েছিলেন। তাঁর নাম ছিল টোনীবাবু। তিনি ছিলেন দীনু হাজরার শিষ্য। ..... মা-র সম্পর্কে পিসতুতো ভাই চন্দননগরের বিপিন ঘোষ আর কেবলবাবুর কাছে পাখোয়াজ ও তবলা বাজানো শিখি।”
গানবাজনার পরিমন্ডলে বড় হয়ে উঠলেও ছোট থেকে তাঁর আগ্রহ ছিল খেলাধুলায়। "খেলার খুব শখ ছিল। স্কুল থেকে আমাদের ক্লাব ছিল। টুর্নামেন্ট হত। কলেজে যখন পড়তুম, কলেজেও খেলতুম। ১৯৩১ থেকে সে সব বন্ধ হয়ে গেল। চোখ খারাপের জন্য। চোখে ফুটবল লেগে after effect – এ অন্য চোখেও দেখতে পাচ্ছিলাম না।”
এই সময় তিনি সকালে আইন পড়তেন আর বিকেলে খেলা। একদিন খেলা শেষে বাড়ি ফেরার সময় খেয়াল করলেন বাঁ চোখটা চাপা দিলে ডান চোখে ঝাপসা দেখছেন- “ছোটকাকার বন্ধু ডাক্তার গৌর ব্যানার্জী দেখলেন”। জানা গেল রেটিন্যাল হেমারেজ।
আত্মজীবনীতে লিখেছেন, "তখনকার দিনে চিকিৎসাও ঠিকমতো হল না। ডান চোখটা তখনই গেল।দার্জিলিং বেড়াতে গেলাম, ঘোড়ায় চড়লাম। ডান চোখ তো আগেই গিয়েছিল এবার বাঁ চোখও আক্রান্ত হল। তখন আর পরীক্ষা দেওয়া হল না। আর তখনই আমার জীবনের মোড়ও ঘুরে গেল”। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পালি ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া জ্ঞানপ্রকাশ যখন এম. এ ক্লাসের ছাত্র তখনই তাঁর এই দুর্ঘটনা ঘটে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ইতি টানতে হল। খেলার জগৎ থেকেও হল চির নির্বাসন।
শুরু হল তাঁর জীবনের আর এক অধ্যায়। অন্ধকারে তিনি দেখতে পেলেন আলোকরশ্মি- সঙ্গীত জীবন। বাড়িতে গানবাজনার আবহ তো ছিলই। “আমার বড় দাদা খুবই মেধাবী ছিলেন। Western music করতেন। বেহালা বাজাতেন। .... তাঁর কাছ থেকে উনি যা করতেন সে সম্বন্ধে আমার মোটামুটি একটা আইডিয়া হয়েছিল”। ভাই, বোন, বাবা, ঠাকুর্দা সকলের মধ্যেই সুরের চর্চা ছিল। এমনকি “মা-কেও বীণাবাদিনী পত্রিকা খুলে ‘আয় তবে সহচরী’ গান বাজাতে শুনেছি। তখন স্কুলে পড়ি, একটু বড় হয়েছি তখন রবীন্দ্রনাথ যখনই কলকাতায় আসতেন, বাবা দলবল নিয়ে তখনই আমাদের গান শোনাতে নিয়ে যেতেন।
বাড়ির লোকেদের ইচ্ছে ছিল তিনি যেন চিত্রশিল্পী হন। কেননা ছোট থেকেই তিনি ভালো ছবি আঁকতেন। তাঁর আঁকা ছবি দেখে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলেছিলেন ম্যাট্রিক পাশ করার পর তাঁর কাছে যেতে। বাড়ি থেকে তাঁকে ইটালি পাঠানোর কথা হলেও দাদাদের দেখাদেখি জ্ঞানপ্রকাশ চাইলেন কলেজে পড়তে। ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ তবলা, পাখোয়াজ বাজাতেও শিখেছিলেন। তিনি আজীম(কোথাও বলেছেন আজম)খাঁর কাছে তবলার তালিম নিতে শুরু করেন।
এক বছর শেখার পর আজীম খাঁ চলে গেলে তিনি মসীদ খাঁর কাছে তবলা শিখতে শুরু করেন। এরপর শুরু হল তাঁর গান শেখার পালা। ছোটবেলা থেকেই গানের গলা থাকলেও গান শেখা হয়নি। “গান আমি তবলা শিখতে শিখতেই আরম্ভ করেছিলুম। সাদ্দাম খাঁ বলে একজনের কাছে। তাছাড়া দবীর খাঁ সাহেবের কাকা উজীর খাঁ সাহেবের ছোট ছেলের কাছে শিখতুম। তাছাড়া আমরা যখন গিরিডি যাই, সেই সময় দবীর খাঁ সাহেবের কাছে শিখতুম। ১৯৩৯ এ আমি গিরিজাবাবুর কাছে শিখতে আরম্ভ করলুম।” একনাগাড়ে গিরিজাবাবুর মৃত্যুকাল পর্যন্ত শেখার সুযোগ হয়েছিল জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের। এই সময় থেকে তিনি একক অনুষ্ঠান করতে শুরু করলেন ।
আজীম(আজম)খাঁ- র কাছেই জ্ঞানপ্রকাশ সন্ধান পান মসীদ খাঁ-র। “তিনি অত্যন্ত অমায়িক লোক ছিলেন এবং আমি ওঁর কাছে খুবই ঋণী। উনি আমাকে বিশেষ যত্ন করে শেখাতেন। কেরামৎ খাঁ-র সঙ্গে আমি একসঙ্গে রেওয়াজ করতুম এবং আমি দেখতুম কেরামৎ খাঁ আমার থেকে অনেক advanced ছিল।” কী রকম রেওয়াজ করতেন তিনি? “ আমার চোখের গন্ডগোলের জন্য তো পড়তে পারতুম না। মারাত্মক প্র্যাকটিস করতুম না। তবে করতুম...তা দিনের মধ্যে পাঁচ-ছ ঘন্টা তো হত।”
দীর্ঘ দিন তিনি কেরামৎতুল্লা খানের সঙ্গে রেওয়াজ করেছেন। “কেরামৎ ছেলেবেলা থেকেই একটা creative artist.........ভয়ানক intelligent, ভয়ানক talented....কেরামৎ, মুন্নে খাঁ আর আমি আলাদা বাজাতুম।”
১৯৩৭ সাল থেকে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ শেখার পাশাপাশি শেখাতেও শুরু করেন। তাঁর বৈশিষ্ট্য এখানেই যে তিনি তবলা শেখাকে নিছক বাঁধা কায়দা মুখস্থ করে খাতায় লিখে হাতে বাজানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন না। “কিন্তু আমি বলছি আর একটা জিনিস অভ্যাস করা। যেটা আমি করতুম।...... তবলাকে একটা ভাষা হিসেবে তৈরি করা। ...আমি বলছি তবলাটা ধরবে না।শুধু মুখে মুখে চিন্তা করা- মুখে চিন্তা করে বলবে। তারপর brain চিন্তা করছে আর হাত বাজাচ্ছে। এই তিনটে জিনিসের যদি সংযোগ হয় তবে শুনতে আরও ভালো হয়"। এই চিন্তা থেকেই তৈরি ‘নগেনের গিন্নীর দাঁত কনকন...’ আর ‘নিতাই খুড়ো.....’-এর মতো অনন্য সৃষ্টি।
যার প্রসঙ্গে পন্ডিত রবিশঙ্কর বলেছিলেন, “জ্ঞানদার বহুমুখী গীতবাদ্য রচনার মধ্যে ‘নগেনের গিন্নী’ ও ‘নিতাই খুড়ো’ বিশেষ এবং তাৎপর্যপূর্ণ সৃষ্টি। শুধু হাস্যোরসোদ্রেকের জন্য নয়, এর ভিতরে মুন্সীয়ানার তুলনা নেই। কাহিনীর অভিনবত্ব, তার গঠনের প্রণালী ও হাস্যরসের প্রস্রবণ ছাড়া খুবই টেকনিক্যাল কারুকার্যের পরাকাষ্ঠা রয়েছে এর অক্ষরে অক্ষরে। সরস বাংলায় বর্ণনার মধ্য দিয়ে তবলার বোলের নিকাস-কে তার নিজস্ব আঙ্গিকে রূপায়িত করা হয়েছে নিখুঁত ভাবে।”
এই 'বোল রচনার তাল oriented চেষ্টার' তারিফ করেছিলেন তুলসী লাহিড়ী, করেছিলেন বড়ে গুলাম আলি খাঁ - “বিশেষ করে গন্ডা গন্ডা খোকাখুকু”র জায়গায় গুলাম আলি সাহেব অট্টহাস্যে এমন লুটিয়ে পড়লেন যে আতঙ্কে আমার প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায় আর কি।”
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সম্পর্কে তাঁর ছাত্রী বিজ্ঞানী পূর্ণিমা সিংহ বলেছিলেন, “তাঁর বক্তব্য প্রকাশের ভাষা এত অনবদ্য ঘন্টার পর ঘন্টা শুনলেও ক্লান্তি ঘটে না। এত জিনিস জানতেন, পারতেন যে চব্বিশ ঘন্টায় তাঁর কাজ কখনও শেষ হত না। তাছাড়া এত সুরসিক যে পরিপূর্ণ আনন্দে মেতে থাকতেন। মনে পড়ল, ক্লাসে একদিন ব্যস্তভাবে তবলা- গান শিখিয়ে চলেছেন। বাড়ি থেকে ফেরার তাড়া এল। বললেন, “এই গানটা, তবলাটা শেষ করে নিই- আবার গিটারএসে যেতে পারে।”
এমন সময় গীটারের গৎ নিতে এক ব্যক্তির প্রবেশ"। এই বহুমুখী সঙ্গীত সাধনা এবং শেখানোয় জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ অতুলনীয়।
রম্যগীতির গানে তিনি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন।কথা ও সুরের অপরূপ মেলবন্ধনে তাঁর তৈরি রম্যগীতিগুলি অপরূপ হয়ে উঠেছে। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুযোগ্য ছাত্র প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া ' নিশীথ শয়নে জাগে আঁখি উদাসী', মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে 'আমি সুরে সুরে ওগো তোমায় ছুঁয়ে যাই', 'বন্ধু হে পরবাসী', বাণী কোনারের গাওয়া 'কূল ছেড়ে এসে মাঝদরিয়ায়' ইত্যাদি। তাঁর শিক্ষিত মনন এবং বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তন তাঁকে এক ব্যতিক্রমী শিল্পী হতে সাহায্য করেছিল।
আমীর খাঁ সাহেবের সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজানোর অভিজ্ঞতাও ছিল তাঁর। জানিয়েছেন কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, "হার্মোনিয়ামেও উনি জ্ঞানবাবুকেই একমাত্র খুশি হয়ে সঙ্গে বসাতেন। কারণ জ্ঞানবাবু শুধু 'তেজ দিমাক' অর্থাৎ তীক্ষ্ণধী মাত্র নন, ওঁর বহুকাল ধরে আমীর খাঁ সাহেবের গায়কির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল"। একদিকে গান, অন্যদিকে তবলা এই দুটি ধারা জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের জীবনে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা করেও অন্য ধরণের সঙ্গীতও তিনি গড়ে তুলেছেন। রম্যগীতি ছাড়াও তিনি সুকুমার রায়ের তিনটি কবিতায় সুর দিয়েছিলেন। 'গন্ধবিচার', ' দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম', ' নেড়া বেলতলাতে যায় ক বার'-এই কবিবাগুলিতে তাঁর সুরসংযোগ এক অসাধারণ সৃজন। আটমাত্রার দ্রুত লয়ের গানে তাল পরিবর্তিত হয়েছে বহুবার। শৈলেন মুখোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় ও জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের গাওয়া গানগুলি বাংলা গানে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি যে 'বুড়ো বুড়ি দুজনাতে, মনের মিলে সুখে থাকত'-তেও সুর দিয়েছিলেন সেকথা মনে করিয়ে দিয়েছেন পূর্ণিমা সিংহ। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ গান রচনা করেছেন ট্রেনে বসে, মাঝরাতে উঠে- কখন নয়? সব মিলিয়ে তাঁর লেখা্ গানের সঠিক সংখ্যা বলা মুশকিল।
১৯৪১ সালে নীতিন বসুর আহ্বানে জ্ঞানপ্রকাশ গেলেন মুম্বাই। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের 'বিচার' ছবির মিউজিক ডিরেক্টর হয়ে।এই ছবির সূত্রে আলাপ হল ব্রতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। দেখা হল পাহাড়ী সান্যালের সঙ্গেও। পাহাড়ী সান্যালের রেকর্ডে তিনি গিটারবাজিয়েছেন। বাজিয়েছেন দিলীপ রায়, উমা বসু, শচীন দেববর্মণের গানের সঙ্গেও। 'মান্না দে-কে দিয়ে আমিই প্রথম ফিল্মে গাওয়ালাম'- বলেছেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। মুম্বাইতে তিনি হিন্দি ছবি 'পরায়া ধনে'ও মিউজিক ডিরেক্টরের কাজ করেছিলেন। তাছাড়া অভিনয়ও করেছিলেন। হঠাৎ করে এক শিল্পীর অনুপস্থিতিতে 'পরায়া ধন' ছবিতে ডাক্তারের ভূমিকায় তিনি অভিনয়ও করেছিলেন।
আকাশবাণীর সঙ্গে দীর্ঘদিন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের। সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে তিনি পনেরো বছর আকাশবাণীতে কাজ করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে নিজের বাড়িতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন 'ঝঙ্কার' সংস্থা, যেখানে বড়ে গোলাম আলি খাঁ, বিলায়েত খাঁ, বহু গুণী শিল্পী সঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। একাধিক বাংলা চলচ্চিত্রেও তিনি সঙ্গীত সংযোজন করেছেন। যদুভট্ট, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত ইত্যাদি। ‘দ্য ড্রামস অফ ইন্ডিয়া’ অর্কেস্ট্রায় তিনি বাঁয়া, খোল, তবলা এনসেম্বল, বাংলা ঢোল, মাদল, খমক, হুরুক, মৃদঙ্গ, ঢোলক ইত্যাদির সংমিশ্রণে এক অপূর্ব রস সৃষ্টি করেছিলেন। একই সঙ্গে তবলা এবং কন্ঠসঙ্গীতে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ যে ধারার প্রবর্তন করে গিয়েছেন পন্ডিত রবিশঙ্কর তার নাম দিয়েছেন ‘কলকাতা ঘরানা’। শিল্পী হিসেবে তিনি গুণী তো ছিলেনই কিন্তু তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ছাত্র তৈরি। এক সাক্ষাৎকারে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বলেছিলেন, “যাদের আমি শিখিয়েছি তাদের কাছেও আমি শিখেছি।” বলেছেন, “কোনও জিনিস না বুঝে শেখাইনি।”
মনে করিয়ে দিয়েছেন, “সংযম এবং পরিমিতিজ্ঞান সেটাই সবচেয়ে বড় জিনিস।”
আমেরিকা,কানাডার নানা জায়গায় তিনি শিখিয়েছেন। তাঁর বাড়িতে এসে তালিম নিয়েছেন এমন শিল্পীর সংখ্যাও কম নয়। তবলায় যাঁরা তাঁর কাছে তালিম নিয়েছিলেন তাদের অন্যতম প্রবোধ ভট্টাচার্য, নিখিল ঘোষ, কানাই দত্ত, শঙ্কর ঘোষ, গোবিন্দ বসু, শ্যামল বসু, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। কন্ঠসঙ্গীতে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, এ কানন, অজয় চক্রবর্তী, অরুণ ভাদুড়ী প্রমুখ। আমেরিকা ও কানাডার নানা অঞ্চলে তিনি শিখিয়েছেন। সানফ্র্যান্সিস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি, বার্কলে, পেনসিলভানিয়া ও ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে তিনি তবলা শিক্ষক ছিলেন।
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাবার রেডিয়োর ব্যবসা থাকায় তাঁদের বাড়িতে বহু শিল্পীর আসা-যাওয়া ছিল। পরবর্তী সময়েও তাঁর ডিক্সন লেনের বাড়িতে এসেছেন বড়ে গোলাম আলি খাঁ সহ আরও কত গুণীজন। তাঁর সংগ্রহে তাই অনেক কাহিনি ছিল। এমনই কিছু কাহিনি শুনিয়েছেন কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। "জ্ঞানবাবুও বলেছিলেন, 'তখন সবে গোলাম আলি খাঁ- র সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ওঁকে ডিক্সন লেনে এনে তুলেছি। পরের দিন উনি রেওয়াজে বসেছেন, আমার হাতে তবলা। তখনও গলা গরম হয়নি। মধ্যলয়ে একতালায় তেরেকেটে ধিন্ পেরিয়েছি, হঠাৎ বিদ্যুতের মতো অতি তারার সা ছুঁয়ে মুখড়া পড়ল শমে। ধা ধা ধিন্ বাজাতে যতটুকু সময় লাগল তারই মধ্যে এই কান্ডটা ঘটে গেল।”
আর একটি ঘটনা- ডিক্সন লেনেরই বাড়িতে। নাপিত তখন ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কামাচ্ছে আর খাঁ সাহেব তাকিয়ায় আধশোয়া, “এই সময়ে ওঁর তান মারবার বাসনা হল। নাপিত অস্তর সরাবার চেষ্টা করতে উনি ইশারায় বারণ করে দু সপ্তকের সপাট মারতে লাগলেন, শরীর নড়ছে না, চোয়াল নড়ছে না, জিভও নড়ছে না। এদিকে ওঁর ‘ডবল চিনের’ ওপর ক্ষুর চলছে।”
লেখার হাত ও দেখার চোখ তাঁর কতখানি ছিল তার প্রমাণ আছে স্মৃতিকথায়। ১৯৫৪ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পাঠানো দলের তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। ছিলেন রবিশঙ্করও। জর্জিয়ায় তাঁরা পথের দু’ধার থেকে এত আঙুর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছিলেন যে রবিশঙ্কর বলেছিলেন দেশে ফিরে আর দু'বছর আঙুর খেতে হবে না।
পণ্ডিত রবিশঙ্করের জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কমিক গানে দোহার হ ওয়া, পোলিশ লোকগীতি গাইবার গল্পও ছিল তাঁর সম্ভারে।
সদাব্যস্ত জ্ঞানপ্রকাশ একবার বলেছিলেন, “শিল্পী হিসেবে কিছু না কিছু করে আমি থাকতে পারি না।” তাঁর সমগ্র জীবন এই কথাটির যথার্থতার প্রকাশক।