কবি বিষ্ণুচরণ দে যেমন সাহিত্যজগতে 'চরণ' ছেঁটে বিষ্ণু দে হয়েছিলেন, তেমনি মতিলাল নন্দী-ও 'লাল' ছেঁটে হয়েছিলেন, মতি নন্দী। তিনি পাঁচের দশকের কথাকার। 'দেশ'-পত্রিকায় 'ছাদ'-গল্পটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব। এই আবির্ভাবের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবেই যেন সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি যোগসূত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল। গল্পটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫৬, আর মানিকের মৃত্যু হল, এর কয়েকদিন আগে, ৩ ডিসেম্বর। যেন, এক বরেণ্য সাহিত্যিক সাহিত্যক্ষেত্র ছেড়ে প্রস্থান করলেন, আর সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে এক ভাবী-বরেণ্যর আগমন ঘটল! আরও আশ্চর্যের, এক প্রতিযোগিতায় ১৯৫৮-এ এসে তাঁর উপন্যাস 'ধুলো বালির মাটি' পেল 'মানিক স্মৃতি' প্রথম পুরস্কার। বাংলা সাহিত্যে সেই সময় তাঁকে 'ছোট মানিক' বলা হতে লাগল। অগ্রজ সাহিত্যিক সন্তোষ কুমার ঘোষ তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন--"তাঁর সরাসরি আত্মীয়তা কোন পূর্বসূরীর সঙ্গে?--মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। পারিবারিক চেহারার মিলটা সহজেই চেনা যায়।" এখানে সন্তোষবাবু 'পারিবারিক চেহারার মিল' বলতে কী বোঝাতে চাইলেন? আত্মপ্রকাশপর্ব পর্যন্ত মতি নন্দীর সাহিত্যজীবনের রূপরেখাটি অনুসন্ধান করলে হয়তো এ মন্তব্যের মানে বুঝতে পারব...
১৯৩১ সালের ১০ জুলাই, উত্তর কলকাতার তারক চ্যাটার্জি লেনে জন্ম হয়েছিল মতি নন্দীর। পাঁচ ভাইবোনের কোলে তিনি সবচেয়ে ছোট। জ্ঞানগম্যি হবার আগেই, তাঁর যখন মাত্র সতের মাস বয়স, তখন বাবা মারা গেলেন। কিশোরবেলায় যুদ্ধের দামামা বাজল। শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কলকাতায় বোমা পড়ল। দলে দলে মানুষ কলকাতা ছাড়তে লাগলেন। মতির পরিবারও ছাড়লেন, গেলেন হুগলির দশঘরা গ্রামে। বয়স তখন সবে, এগারো বছর পাঁচ মাস। মৃত্যু আতঙ্কের দিনরাত্রি চোখের সামনে থেকে সরে গিয়ে বুকে পেলেন এক নির্মল নিস্তরঙ্গ গ্রাম। পেলেন, উদার প্রকৃতি ও অকৃত্রিম আনন্দ, সরল ও বৈচিত্র্যময় জীবনের সন্ধান। কিন্তু, বেশিদিন এ সুখ সইল না। গ্রামবাংলার আদি অসুখ ম্যালেরিয়ায় কাবু হলেন। কলকাতার পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। তাই তাঁকে সারিয়ে তুলতে সোজা নিয়ে যাওয়া হল দিদির বাড়ি কুমিল্লায়। সেখানে পুরো একটা বছর থেকে যখন কলকাতায় ফিরলেন, তখন পথে পথে অন্নহীন কঙ্কালসার মানুষের মৃত্যু মিছিল। আকাশে-বাতাসে কাতর, ফ্যান দাও চিৎকার। দেখলেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। একটি কিশোর যৌবনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিটি পদক্ষেপে দেখতে লাগলেন রূঢ় বাস্তবের কুৎসিত মুখ, সাক্ষী হলেন সমাজ বাস্তবতার। আর সেই জন্যেই বোধহয় মাখোমাখো আতুপুতু প্রেমের রোমান্টিকতা মানিকের মতোই তাঁর সাহিত্যেও পরবর্তীতে তেমন গুরুত্ব পায়নি; যেভাবে সমাজবাস্তবতায় মানুষের অধিকার-সংগ্রামের কথা মূর্ত হয়েছে। পরবর্তী ক্রীড়াভিত্তিক সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। এই ঘরানার চেহারাগত মিলের কথাই বোধহয় সন্তোষ কুমার ঘোষ বোঝাতে চেয়েছেন তাঁর মূল্যবান মন্তব্যে।
যৌবনে অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও মতি মনের মতো কাজ পেলেন না। তবে, মনের মতো সঙ্গ তিনি আজীবন পেয়েছেন। তারক চ্যাটার্জি লেনে তাঁর শৈশব-কৈশোর-যৌবন কেটেছে পরবর্তীকালের বিখ্যাত নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায়, গায়ক ও সুরকার বিমান মুখোপাধ্যায়, কবি শিবশম্ভু পালের মতো বন্ধুদের সঙ্গ পেয়ে। এঁদের মধ্যে শিবশম্ভু পালই একদিন এ-সময় তাঁকে নিয়ে গেলেন তাঁদের সাহিত্যসভা--'প্রবাহ সাহিত্য গোষ্ঠী'-তে। এখানে স্বরচিত কবিতা পাঠ ও আলোচনা করেন শিবশম্ভু, বীরেন্দ্র দত্ত এবং মোহিত চট্টোপাধ্যায়। মোহিত তখন শুধুই কবি, নাট্যরচনা শুরু করেননি। গোষ্ঠীতে গল্পকার নেই। তাই মতিকে গল্প লিখতে হবে। বেশ। মতি কলম ধরলেন। মানিক যেমন বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে কলম ধরেছিলেন, তেমনি মতি ধরলেন বন্ধুদের উৎসাহ ও অনুরোধে। চ্যালেঞ্জটা এলো পরে। তিনি প্রতি সপ্তাহে একটি করে গল্প লেখেন, সভায় পড়েন, আলোচনা হয়, কিন্তু, গল্পটির অসাধারণত্বের কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এভাবেই কেটে গেল চার-চারটে বছর। প্রকৃত সমালোচনা মাথায় নিয়ে এতদিন যেন নিজেকে তিলে তিলে তৈরি করলেন মতি, কলমকে সাধনা দিয়ে স্ববশ করলেন। লিখে ফেললেন, ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাসে 'ছাদ' গল্পটি। পড়লেন সভায়। গল্প শেষ হতেই লাফিয়ে উঠলেন তিন বন্ধু--দারুণ!--এ গল্প এক্ষুনি 'দেশ'-এ পাঠানো চাই। মতির হাতের লেখা ভালো ছিল না। সুতরাং, ঝাঁপিয়ে পড়লেন বন্ধুরা। পরিষ্কার মুক্তোর মতো হাতে লেখায় গল্পটি কপি করলেন শিবশম্ভু এবং 'দেশ'-পত্রিকার দপ্তরে তা পৌঁছে দিলেন বীরেন্দ্র। এবার, অপেক্ষা...। অপেক্ষার অবসান হল কয়েক মাস পরে। গল্পটি ছাপা হল। লেখক সাম্মানিক পেলেন কুড়ি টাকা। এটাই সাহিত্যে তাঁর প্রথম আয়।
পাঁচের দশক। ফর্ম নিয়ে নিরীক্ষার দশক। সাহিত্য দর্শনের মুক্তির দশক। সদ্য-সাহিত্যিকদের অনেকেই 'দ্য আউটসাইডার' পড়ে কাম্যু-কাতর হয়ে নতুন কিছু করার উন্মাদনায় উন্মুখ হলেন। সাহিত্যিক বিমল কর স্বরচিত ও সতীর্থদের মোড় ঘোরানো কিছু ছোটগল্প প্রকাশ করলেন, 'ছোটগল্প : নতুন রীতি'--নামের সম্পাদিত গ্রন্থে। এতে মতি নন্দী'র 'তাপের শীর্ষে' গল্পটি প্রকাশিত হল। উপস্থাপনে কাম্যুর প্রভাব থাকলেও বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে, এ গল্প কিন্তু একেবারেই ছকভাঙা একটি সৃষ্টি।
ঘনিয়ে এলো প্রেক্ষাপট বদলের দিন। ব্যক্তিগত রুচি সাহিত্যে উঠে আসার কাল। সাহিত্যের সঙ্গে ফুটবল এবং ক্রিকেট--এ দুটোও ছিল ব্যক্তি মানুষ মতির খুব প্রিয়। নিয়মিত ময়দানে গিয়ে খেলতেন। কারণ, তিনি ছিলেন একাধারে খেলোয়াড় ও সাহিত্যিক। সুতরাং, খেলা তাঁর সাহিত্যে বিষয় ও চরিত্র হয়ে কোনদিন আসবে না, তা কী হয়? সুতরাং, ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৯ সালে "অমৃত" পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর 'শূন্যে অন্তরীণ' গল্পটি। গল্পটির বিষয়, ময়দানের ক্রিকেট। এভাবেই বাংলা সাহিত্য এই প্রথম পেল একজন ক্রীড়া-সাহিত্যিককে এবং বাংলা সাহিত্যে 'ক্রীড়া-সাহিত্য' নামে নতুন একটি ধারার সূচনা হল। 'কোনি', 'স্টপার', 'স্ট্রাইকার', 'জীবন অনন্ত', 'ননীদা নট আউট'--সেই ধারারই সুগন্ধি ফসল। তিনি যে সাহিত্যে ক্রীড়াকে চরিত্রের সম্মান দিয়েছেন, শুধু তাই নয়; ক্রীড়া সাংবাদিকতাও যে সরস হয়ে উঠে আপামর জনগণের মন ছুঁয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে, তার পথ তিনিই প্রথম দেখিয়ে ছিলেন--'আনন্দ বাজার পত্রিকা'র 'মাঠে ময়দানে' ক্রোড়পত্রে। তাই, বাংলা সাহিত্য যতদিন থাকবে, ক্রীড়া সাংবাদিকতা যতদিন তার ধারা অক্ষুন্ন রাখবে; ততদিন সংগ্রামের কথাকার ও নতুন ধারার রূপকার হিসেবে মতি নন্দী চিরনন্দিত থাকবেন।