স্বামী বিবেকানন্দের পাড়া। সিমলা স্ট্রিটের মদন ঘোষ লেন। সেখানেই, দে-বাড়ি। সঙ্গীতাচার্য্য কৃষ্ণচন্দ্র দে'র বিপুল সুখ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে সে-বাড়িও তখন সুবিখ্যাত। সঙ্গীত-তীর্থ। ওস্তাদ বাদল খাঁ সাহেব, ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁ সাহেব, ওস্তাদ দবীর খাঁ সাহেব, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, শচীনদেব বর্মণ, ওস্তাদ হাফিজ খাঁ সাহেব, ওস্তাদ ফৈয়জ খাঁ সাহেব, বেগম আখতারের মতো ভারতশ্রেষ্ঠ সঙ্গীত সাধকদের আগমনে নিত্যধন্য ধাম। সেই তীর্থেই ১৯২০ সালের ১ মে জন্ম হল, ভাবীকালের আর এক সঙ্গীত-সাধক, প্রবোধচন্দ্র দে'র। মানে, 'মান্না দে'-র।
'মান্না' তাঁর নামই ছিল না। তাঁর আদর-ডাকের নাম ছিল, 'মানা'। 'বাবুকাকা' কৃষ্ণচন্দ্র এবং অতিথি ওস্তাদদের গান শুনে শুনে কৈশোরেই মানার কান তৈরি, সেই গান অবলীলায় গলায় তুলেও নিতে পারেন, তবলায় বোল তুলতে পারেন, অন্ধ 'বাবুকাকা'র গানের খাতায় গান লিখে দেন, নোটেশন লিখে দেন, গান পড়ে শোনান; তবুও গান শেখার কথা কখনই মনে হয়না মানার। বরং, ছাদ থেকে ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো, ঘুড়ি কাটা, আচার চুরি করা, মারপিঠ করা, রাস্তার বোষ্টমের খোল ফাঁসিয়ে দেওয়ার মতো হাজারো দস্যিপনাতেই তাঁর আনন্দ বেশি!
বাড়িতে এই সময় একদিন কাকাকে গান শেখাতে এলেন বাদল খাঁ সাহেব। একটা বেশ জটিল তান শেখাচ্ছেন। বাইরে থেকে কিশোর মান্না সেই তানটি শুনলেন এবং শুনে তাঁর ভারি ভালো লাগল। যা ভালো লাগে, তা গেয়ে উঠতে মন চাইল। গেয়ে উঠলেন। শুদ্ধ ভাবে। শুনে অবাক হলেন বাদল খাঁ সাহেব। ডাকলেন তাঁকে। ছোট্ট একটি ছেলে। তিনি গম্ভীর ভাবে সেই তান আবার গাইতে বললেন। আড়ালে এক রকম, কিন্তু, ওস্তাদের কাছে খুব লজ্জা পেলেন মানা। ছুটে পালিয়ে গেলেন! কাকা হেসে বললেন, শুনে শুনে অনেকটাই তুলতে পারে বটে, ওকে শেখানো তো হয় না...তাই...। ওস্তাদ বললেন, হয় না কেন? শেখানো উচিত, এর হবে!
কাকার কাছেই শুরু হল শিক্ষা। কাকা গাইবেন, তাঁকে তানপুরা বাজাতে হবে। মানা যে তানপুরা ধরতেই জানেন না, বাজাবেন কি! কিন্তু, কে শোনে কার কথা। এদিকে কাকা আদেশ দিয়েই গান গাইতে শুরু করে দিয়েছেন! দায়ে পড়ে মানা বাজালেন। এবং ভুল বাজালেন। কাকা তাঁর ভুলে বিরক্ত হলেন না। বরং রোজই চলতে লাগল এমনধারা রেওয়াজ। এভাবেই মরা মরা একদিন রাম রাম হল, বাজনায় হাত খুলে গেল। জলে ঠেলে দিয়ে সাঁতার শেখানোই ছিল কৃষ্ণচন্দ্রের শিক্ষাপদ্ধতি। শুধু বাড়িতেই নয়, আসরেও তিনি মানাকে দিয়ে সুন্দরভাবে সঙ্গত করিয়ে ছাড়লেন। এভাবেই তিনি হারমোনিয়াম শেখালেন। যে ছেলের কান তৈরি, তাঁর হাত তৈরি হতে কতক্ষণ! কিন্তু, তখনও তাঁকে কণ্ঠসঙ্গীতে তালিম দিলেন না।
ফলত, গান তখনই মানার জীবনের অবলম্বন হল না। তখন তিনি কুস্তির দাওপ্যাঁচ শিখছেন বিখ্যাত কুস্তিগীর গোবরবাবুর কাছে। দু'চারটি কম্পিটিশনে গুরুর মান রেখে তখন তাঁর মনে বড় কুস্তিগীর হওয়ার স্বপ্ন। ঠিক এসময়ই হঠাৎ তাঁর চোখে সমস্যা দেখা দিল, চশমা নিতে হল। চশমা ছাড়া কিছুই দেখতে পান না। কিন্তু, চশমা পরে তো আর কুস্তি হয়না। সুতরাং, সরে আসতে হল আখড়া থেকে।
স্কুল পেরিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হলেন। কোএড কলেজ। যথারীতি আড্ডা জমল লাস্ট বেঞ্চে। সেখানে অফ ক্লাসে বা ক্লাসের গ্যাপে চলতে লাগল বন্ধুদের সঙ্গে বেঞ্চ বাজিয়ে শচীন কর্তা ও কাকার গান। সবাই জানল, দারুণ গান প্রবোধচন্দ্র। গানে এবং বেপরোয়া স্বভাবে প্রবোধ ক্লাসে এবং কলেজে হিরো! মেয়েদের চোখে, বিশেষ। তাই এসময় থেকেই 'প্রবোধচন্দ্র' নামটা তাঁর বড্ড সেকেলে মনে হতে লাগল, মনে হতে লাগল, ইস, যদি নামটা চেঞ্জ করা যেত!
সামনে ইন্টারকলেজ গানের কম্পিটিশন। বন্ধুরা দায়িত্ব নিয়ে মানার নাম লিখিয়ে দিল কম্পিটিশনে। কিন্তু, মানা পড়ে গেলেন ফাঁপরে! তিনি তো গানের তালিমই নেননি, এ তো আর বেঞ্চ বাজিয়ে গান গাওয়া নয়! হিরোইজমের ঠেকায় পড়ে, কাউকে বলতে পারেন না যে, তিনি প্রথাগত গানের ট্রেনিং নেননি! তাই কুল বাঁচাতে অজুহাত দিলেন যে, কম্পিটিশনে নাম দেওয়াটা কাকার পছন্দ নয়। কাকার অমতে তিনি কিছু করতে পারবেন না! এবার বন্ধুরা পড়ল ফাঁপরে, নাম কাটাতে গেলেই তো কলেজের নাক কাটা যাবে! মধ্যিখানে এসে দাঁড়ালেন কলেজের প্রিন্সিপাল, কলেজের নাক, তাঁরও নাক! ফলে, সোজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে হাজির হলেন অনুমতি আদায় করতে। সব শুনে তিনি মানার চাতুরী বুঝলেন। কিন্তু, নিজে সোজাসাপ্টা মানুষ। বললেন, মানা গানই জানে না, তো আসরে গাইবে কি করে! প্রিন্সিপালের ডুবোজলে তখন কুটো ধরার অবস্থা! তিনি বলে বসলেন, আপনি শুধু অনুমতি দিন, যেটুকু জানে তাতেই চলে যাবে! এই 'চলে যাবে!' কথাটা জেদি কৃষ্ণচন্দ্রের অহং-এ গিয়ে লাগল! সঙ্গীতাচার্য্য কৃষ্ণচন্দ্রের ভাইপো প্রথম গাইবে, সেটাও 'চলে যাবে' ধরণের! হয় নাকি! সেটা যে হয়না এটা তিনি মানাকে দিয়েই প্রমাণ করিয়ে ছাড়বেন! ফলে, জেদের বশে তিনি জানালেন, মানা গাইবে। শর্ত একটাই, কম্পিটিশনের ধ্রুপদ, খেয়াল, গজল, ফোক প্রভৃতি দশটি বিভাগেই মানাকে নাম দিতে হবে। বেশ, তাই সই। কম্পিটিশনের মাত্র দু'মাস বাকি। শুরু হল, মানার রাতদিন এক করা কণ্ঠসাধনা। এই দু'মাসে মানা শুধু যে সঙ্গীতে পটু হলেন তাই নয়, কাকা ও কলেজের সম্মানও বজায় রাখলেন। আটটি বিভাগে প্রথম হলেন, আর দুটি বিভাগে হলেন দ্বিতীয়।
মানা এরপরও গায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখলেন না। হতে চাইলেন মিউজিক ডিরেক্টার। তাই কাকার এসিস্ট্যান্ট হয়ে কালী ফিল্মস আর নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে আসাযাওয়া শুরু করলেন। ততদিনে ফিল্মের গায়ক-অভিনেতা এবং সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাকা কৃষ্ণচন্দ্রের খুব নাম হয়েছে। ১৯৪২-এ কৃষ্ণচন্দ্র সঙ্গীত-পরিচালক হিসেবে বোম্বে এলেন। যোগ দিলেন চিমনলাল ত্রিবেদীর, 'লক্ষ্মী প্রোডাকশন কোম্পানি'-তে। মানা কাকার দ্বিতীয় সহকারী হয়ে এলেন। এখানেই 'মানা' লোকমুখে হয়ে উঠলেন, 'মান্না'। সবাই ডাকে, তিনিও সাড়া দেন।
শুরু হল লক্ষ্মী প্রোডাকশনকোম্পানির ব্যানারে প্রথম ছবি, 'তামান্না'। এই ছবির একটি গান রেকর্ডিং হবে, ডুয়েট গান--'জাগো আয়ি ঊষা'। ফিমেল ভয়েস সুরাইয়ার। মেল ভয়েসের জন্য নতুন গায়কের খোঁজ শুরু হল। অনেক অডিশন হল। কিন্তু, কারও ভয়েস কৃষ্ণচন্দ্রের পছন্দ হল না। শেষমেশ তিনি মানাকেই বললেন গানটি গেয়ে দিতে। এভাবেই রেকর্ডিং হল মানার প্রথম প্লেব্যাক। এ-গানের কথাই সেদিন যেন ঘোষণা করে দিলো, ভারতবর্ষ এক নতুন ও বহুমুখী প্লেব্যাক সিঙ্গার পেয়ে গেছে, সূচিত হয়ে গেছে ভারতীয় সঙ্গীতের নতুন ভোর। শুরু হল ইতিহাস। সাধনা, তালিম এবং লড়াই। মিউজিক ডিরেক্টার থেকে হয়ে উঠলেন প্লেব্যাক সিঙ্গার। অপছন্দের 'প্রবোধচন্দ্র' হারিয়ে গেল; পছন্দের ডাকনামেই হল, নামডাক।
তথ্যঋণ: মান্না দে'র অডিও- ভিডিও সাক্ষাৎকার সমূহ। জীবনের জলসাঘরে- মান্না দে।