মানবতাবাদের মহান পুরুষ শিশিরকুমার ঘোষ

শিশিরকুমার ঘোষ। বাংলার সহৃদয় পাঠক তাঁকে চেনেন ছয় খন্ডে চৈতন্য মহাপ্রভুর মহাকাব্য-প্রতিম জীবনী 'শ্রীঅমিয় নিমাই চরিত' রচনার জন্য; আর চেনেন 'অমৃত বাজার পত্রিকা'র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবে। যত ভালোই হোক, এই দুটি কাজের জন্য কেউ 'মহাত্মা' হয়ে যান না। অথচ, এই শীর্ণ ও নিরীহ চেহারার বাঙালিটিকে জীবনীকারেরা 'মহাত্মা' বলেই সম্বোধন করেছেন, কেন করেছেন, সেটাই আমরা আজ পড়তে পড়তে জানব...

শিশিরকুমারের মহানুভবতার পরিচয় প্রথম পেয়েছিলেন অবশ্য তাঁর গ্রামের লোক। তারপর দেশ।তিনি জন্মেছিলেন যে-গ্রামে, সে-গ্রাম যশোরের মাগুরা। তাঁর পিতার নাম, হরিনারায়ণ; মাতা অমৃতময়ী। জন্মসন ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ।

শিশিরকুমারের জন্মস্থান মাগুরা গ্রামে কোন স্কুল ছিল না, বাজার ছিল না; এমনকি অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা পর্যন্ত ছিল না। এ-সবের জন্য কয়েক মাইল পথ নিত্য অতিক্রম করতে হত গ্রামবাসীদের।

শিশিরকুমারের মতোই গ্রামের সমস্ত যুবক সমস্যাটি সম্যক জানতেন, সমস্যাটিতে নিত্য ভুগতেন; কিন্তু প্রতিকারের কোন ভাবনা তাঁদের ছিল না। যদিও শিশিরকুমার পরিবারের সাহচর্যে ঈশ্বরে বিশ্বাস পেয়েছিলেন, কিন্তু ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে হাতে হাত রেখে বসে থাকার শিক্ষা পাননি। তাঁর দুই দাদা বসন্তকুমার, হেমন্ত কুমার এবং ভাই মতিলাল প্রত্যেকেই ছিলেন এই মানসিকতার মানুষ। তাঁরা আজন্ম স্বগ্রামকে ভালোবাসতে শিখেছিলেন। তাঁদের জীবনে স্বদেশপ্রেম এসেছিল সে-পথ ধরেই।

 

SisirKumarGhosh1

 

যা বলছিলাম, শিশিরকুমার যৌবনে পদার্পণ করেই ভ্রাতাদের নিয়ে সমস্ত সমস্যা দূর করে গ্রামের উন্নতিসাধনে দারুণ উদ্যোগ নিলেন। প্রথমে 'ভ্রাতৃসমাজ' নামে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করলেন। গ্রামের চিন্তালেশ যুবকদের একত্র করে স্বগ্রাম-স্বদেশ ও আপন হিতের কথা ভাবতে শেখালেন। তারপর গ্রামে ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন, বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করলেন, প্রাথমিক চিকিৎসালয় গড়ে তুললেন। ব্যধিগ্রস্ত অসহায় মানুষের সেবায় যুবকদের উৎসাহিত করে নিজেরাও দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এ-প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি:

বড়দা বসন্তকুমারের সঙ্গে কী-একটা কাজে যশোর যাবার প্রয়োজন হল শিশিরকুমারের। তখন সন্ধ্যে নেমে এসেছে। সন্ধ্যে হলেই সেকালে গ্রামের রাস্তা জনশূন্য হয়ে উঠত, হয়ে উঠত থমথমে।

সেই থমথমে রাস্তা দিয়েই দুই ভাই পাশাপাশি গল্প করতে করতে হেঁটে চলেছেন। আকাশ হতে গাছগাছালির ফাঁক বেয়ে মৃদু চাঁদের আলো এসে পড়ছে, তাতে আবছা দেখা যাচ্ছে পথ। সঙ্গে আর কোন আলো নেই।

সেই প্রায়ান্ধকার পথে চলতে চলতে হঠাৎ শেয়ালের খ্যাক খ্যাক আওয়াজের সঙ্গে একটি ভয়ার্ত মানুষের ক্ষীণ কণ্ঠ শুনে তাঁরা দুজনেই চমকে চুপ করে চকিতে দাঁড়িয়ে পড়লেন। পথের পাশে বুনো ঝোপালো গাছের জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মাঝে একটিই বড় গাছ। তার তলায় জড়ো হয়েছে রাজ্যের অন্ধকার, সেখান থেকেই শব্দটা আসছে। শব্দটা শুনে প্রথমেই মনে হল, এসময় এ-জঙ্গলে মানুষ! নিশ্চয় কোন অসহায়-বিপদে রয়েছে! যেই এ-কথা মনে হল, অমনি ঝোপ-জঙ্গল মাড়িয়ে দুই ভাই ছুটলেন সেই জমাট অন্ধকারের দিকে। শুকনো পাতার ওপর দু'জোড়া পায়ের অভিঘাতে উঠল দারুণ মড়মড় শব্দ, সেই শব্দে ভয় পেয়ে ল্যাজ তুলে ছুটে পালিয়ে গেল একঝাঁক শেয়াল।

ছুটতে ছুটতে গাছের তলায় পৌঁছে দুই ভাই দেখলেন একটা লোক অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। লোকটা তখনও জ্ঞান হারায়নি। তবে নড়বার-চড়বার ক্ষমতা হারিয়েছে। তার ওপর ভয়ে আরও সিঁটিয়ে গেছে। এখন মানুষের সংস্পর্শ পেয়ে, যেন লোকটা কিছুটা ভরসা পেল। ক্ষীণ কণ্ঠে জানাল নিজের দুরবস্থার কথা :

একটা মোকদ্দমার কাজে যশোরে যাওয়ার পথে এখানেই সে দারুণ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে গিয়েছিল। তারপর ক্রমে নড়াচড়ার ক্ষমতাও হারিয়েছে। এখন শেয়ালের দল হানা দিয়েছে তাকে খুবলে খাবে বলে। এতক্ষণ কোনরকমে হাত নেড়ে দূরে রেখেছে, এরপর আর তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না!

লোকটার দুরবস্থা দেখে শিশিরকুমারের চোখে জল এল। তিনি তার হাতে হাত রেখে বললেন, ভয় পেও না। আমরা তো আছি!

 

SisirKumarGhosh2

 

বলেই লোকটাকে সটান পাঁজাকোলা করে কাঁধে তুলে নিয়ে শিশিরকুমার হাঁটা লাগালেন যশোরের উদ্দেশ্যে। লোকটার সর্বাঙ্গ থেকে মারাত্মক দুর্গন্ধ ভেসে আসছিল। কারণ, বিষ্ঠায় তার অঙ্গ একেবারে মাখামাখি। শিশিরকুমারের মনে কোন ঘৃণা ছিল না, মনে কোন ঘৃণা এল না। যে-সময়ের কথা, সেই সময় কলেরা রুগি চোখের সামনে মরে গেলেও সংক্রমণের ভয়ে কেউ ছুঁয়ে দেখত না। সেখানে অকুতোভয় এই বিশীর্ণ মানুষটি তাঁকে কাঁধে নিয়ে বীরের মতো পৌঁছে গেলেন যশোরের হাসপাতালে। তার যথাযোগ্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করে সেবা দিয়ে সারিয়ে তুললেন। এমন করে পরার্থপর হওয়াটা মানবতার ইতিহাসে কম নয়। শুধু একবার নয়, ঠিক এমনই ঘটনা শিশিরকুমারের জীবনে বহুবার ঘটেছে।

যা বলছিলাম, গ্রামের স্কুল-প্রাথমিক চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গ্রামে একটি বাজারও প্রতিষ্ঠা করলেন শিশিরকুমার। গ্রামের মানুষের প্রয়োজনের সমস্ত কিছু সেই বাজারে সুলভ করার ব্যবস্থা করলেন। মা অমৃতময়ীর নামে সেই বাজারের নাম দিলেন, 'অমৃত বাজার'। কালক্রমে সেই বাজারের সুনাম এমনই ছড়িয়ে পড়ল যে, মাগুরার নামই লোকমুখে হয়ে উঠল, অমৃত বাজার গ্রাম।

শিশিরকুমারের সবচেয়ে বড় কাজ নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নীলচাষীদের পাশে দাঁড়ানো। তিনি দেখেছিলেন যে, যশোর অঞ্চলে নীলকরেরা দাদনের বিনিময়ে কীভাবে চাষিদের কাছে বংশপরম্পরার দাসখত লিখিয়ে নিচ্ছিল, ধানের উর্বর জমিগুলোতে বছরের পর বছর অত্যাচার করে নীল চাষ করিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে দুর্বল করছিল। বাধ্যের মতো চাষ করেও নীলকরদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে চাষিদের মা-বোনেরা রেহাই পাচ্ছিল না, অবাধ্য হলে তো কথাই নেই!

শিশিরকুমার ঠিক করলেন এ ঘৃণ্যপ্রথার শেষ হওয়া দরকার। তাই গ্রামে গ্রামে গিয়ে চাষিদের কাছে গিয়ে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ ও আন্দোলন করতে উৎসাহ যোগাতে লাগলেন। পাশাপাশি হরিশ মুখার্জির 'হিন্দু পেট্রিয়ট' কাগজে বেনামে চাষিদের কথা ওজস্বী ভাষায় তুলে ধরে ইংরেজ রাজপুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাতে লাগলেন।

ফলে, স্বাভাবিকভাবে অচিরেই নীলকরদের বিষ নজরে পড়লেন তিনি। মিথ্যে মামলা-জেল-মোকদ্দমায় তাঁকে জেরবার করে তুলল তারা, তাঁর বাড়ি লুঠ করানোর ষড়যন্ত্র করল। কিন্তু তাঁকে কিছুতেই দমাতে পারল না। বরং, তাঁর উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে চাষিরা একদিন সত্যই নীলচাষের বিরুদ্ধে পথে নামল, সংগ্রাম হল, সরকারের টনক নড়ল, বছর দুয়ের মধ্যে নীল চাষ বন্ধ হল। তখন বিদ্রোহে সিদ্ধি পেয়ে দাসখতমুক্ত চাষিদের মধ্যে আবার আনন্দের জোয়ার এল। আর এই পুরো গণ-জাগরণে পাশে থেকে শিশিরকুমার হয়ে রইলেন তাঁদের পরম আদরের, পরম শ্রদ্ধার 'সিন্নিবাবু' (অর্থাৎ, সিদ্ধিবাবু)।

পরিবার থেকে শিশিরকুমার যে মানবতার পাঠ পেয়েছিলেন, যে মানবতার শিক্ষা তিনি প্রতিবেশ থেকে অর্জন করেছিলেন, তারই বিস্তার ঘটেছে 'অমৃত বাজার পত্রিকা' প্রকাশের মধ্য দিয়ে। পরাধীন দেশ ও জাতির দুর্দশার কথা নির্ভীক ভাবে তুলে ধরতে গিয়ে, নিদ্রিত জাতিকে জাগাতে গিয়ে, দোহাই দেওয়া মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে গিয়ে তিনি ও তাঁর পত্রিকা বার বার শাসকের কোপে পড়েছে, তবুও শিশিরকুমার আদর্শ থেকে একচুল সরে দাঁড়াননি। তাই শিরদাঁড়া বিক্রির এই যুগে এমন মানবতাবাদী অনমনীয় আদর্শ চরিত্রের মানুষটিকে তাই একমাত্র 'মহাত্মা' সম্বোধনেই প্রকৃত সম্মান জানানো যায়, প্রকৃত প্রণাম জানানো যায়...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...