কলকাতার জল তখন সবার পেটে সহ্য হত না। বলছি উনিশ শতকের প্রথম অর্ধের কথা। সেই সময় মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামের ছেলে ঈশ্বরচন্দ্রের সহ্য হয়নি, নদিয়ার বিল্বগ্রামের ছেলে মদনমোহনেরও সহ্য হল না। বামুনের ছেলের জন্য তখন সংস্কৃত-বিদ্যে বাঁধা। আর তায় উচ্চশিক্ষা কলকাতা না-এলে সম্ভব হত না। তাই পড়াশুনো করতে গ্রাম থেকে ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতায় এসেছিলেন বাবার সঙ্গে, মদনমোহন এলেন কাকা রামরতন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এই তাঁর গ্রাম ছেড়ে প্রথম নগরে আসা।
নগরে এসে জল-দোষে অচিরেই পেটের রোগ ধরল। সে-রোগে এমন বাড়াবাড়ি হল যে, বাড়ি না-ফিরে আর উপায় রইল না।
আরামের জন্য সেখানেই বেশ কিছুদিন থাকতে হল। তাই বলে পড়াশুনোয় কিন্তু ফাঁকি দেওয়া গেল না। এই সময় রামদাস ন্যায়রত্ন, বনমালী বিদ্যারত্ন ও শিবদাস সিদ্ধান্ত--তিন রকমের ডিগ্রিধারী তিনজন গৃহ-গুরুর তত্ত্বাবধানে তাঁর বিদ্যাশিক্ষা চলল।
শরীর কিছুটা সুস্থ হতেই আবার একদিন কলকাতা যাত্রার কাল এল। এ-বার এসে ভর্তি হলেন সংস্কৃত কলেজে। এখানেই সহপাঠী হিসেবে পেলেন ঈশ্বরচন্দ্রকে। অল্পদিনেই চাটুজ্যে আর বাঁড়ুজ্যেতে বেশ হালায়-গলায় ভাব হয়ে গেল।
ঈশ্বরচন্দ্র আর মদনমোহন, দু'জনেই ছাত্র হিসেবে অসাধারণ। প্রথম স্থান ক্রমান্বয়ে হল দু'জনের জন্য বাঁধা। একবার ইনি, তো আর-বার উনি। তবুও প্রগাঢ় বন্ধুত্বের কারণে মধ্যিখানে রেষারেষি কোন জায়গাই পেল না।
কিছুদিনের মধ্যেই ভাষা ও অলঙ্কারশাস্ত্রে মদনমোহন এমন পারঙ্গম হয়ে উঠলেন যে, সংস্কৃতের একখানা সুললিত কাব্য বাংলা ভাষায় নিজস্বতা জারিয়ে অনুবাদই করে ফেললেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র সতেরো। কাব্যটি প্রেমের কাব্য, 'রসতরঙ্গিনী'। লেখালেখির এই সূচনা থেকেই সাবলীল ও সহজ ভাষা হয়ে উঠল তাঁর লিখনশৈলী :
"বরং দিবস ভালো নিশা যেন হয় না।
অথবা নিশাই ভালো দিন যেন রয় না।।
কিংবা এ উভয় সখি! প্রাণে আর সয় না।
প্রিয় বিনে আর মনে কিছু ভালো লয় না।।"
কলেজীয় পাঠ শেষ করে ঈশ্বরচন্দ্র উপাধি পেলেন 'বিদ্যাসাগর', আর মদনমোহন পেলেন, 'তর্কালঙ্কার'। ব্যস, ঈশ্বরচন্দ্রের মতোই মদনমোহন চট্টোপাধ্যায় সমাজে ও কর্মক্ষেত্রে 'মদনমোহন তর্কালঙ্কার' নামে পরিচিত হতে শুরু করলেন। কাব্য-কবিতাও লিখতে শুরু করলেন এই নামে।
কলেজের অনেক অধ্যাপকই মদনমোহনের কবিত্বশক্তির অনুরাগী ছিলেন, বন্ধুরা তো বটেই। তাঁদের উৎসাহে একদিন তিনি বসলেন সংস্কৃত সাহিত্যিক সুবন্ধুর গদ্যকাব্য 'বাসবদত্তা'কে বাংলায় কাব্যরূপ দিতে। বাংলার সাহিত্যজগতে তখন আঠেরো শতকের কবি ভারতচন্দ্র রায়ের প্রেমকাব্য 'বিদ্যাসুন্দর' নিয়ে খুব মাতামাতি চলছে। 'বাসবদত্তা'-ও প্রেমকাহিনি। তাই তার অনুবাদ করতে বসে মদনমোহন প্রতিজ্ঞা করলেন যে, হুজুগে বাঙালিকে 'বিদ্যাসুন্দর'-এর চেয়ে উৎকৃষ্ট প্রেমকাব্য লিখে তাক লাগিয়ে দেবেন, না-পারলে কবিতা লেখাই ছেড়ে দেবেন!
ব্যস, শুরু করলেন রচনা। একদিন তা শেষও করলেন। তারপর বসলেন বিচার করতে। নিজেই। ভারতচন্দ্রের 'বিদ্যাসুন্দর', আর স্বরচিত 'বাসবদত্তা', পাশাপাশি রেখে। সমালোচক হিসেবে তিনি ভারি নির্মোহ মানুষ, সেখানে তিনি নিজেকেও রেয়াত করেন না। ফলত, ভাব-ভাষা-রচনাশৈলীর বিচারে 'বিদ্যাসুন্দর'কেই জয়ী করলেন। আর প্রতিজ্ঞা বজায় রেখে নিজে ছাড়লেন কবিতার পথ।
কবিতার পথ থেকে সরে শিক্ষকতার বৃত্তি নিয়ে তিনি এসে পড়লেন শিক্ষা ও সমাজসংস্কারের পথে। এ-পথে নেমে তিনি মিত্র ঈশ্বরচন্দ্রের মতোই কখনও ঘর বাঁচাতে বসলেন না। প্রথম বিবাহ যদি ঈশ্বরচন্দ্র দিলেন, তো তার ঘটকালি করলেন স্বয়ং মদনমোহন। তার জন্য তাঁকে আপন সমাজে প্রায় ন'বছর একঘরে হয়ে থাকতে হল। তবু নিজের বিশ্বাস ও কর্তব্যের সঙ্গে তিনি কখনও আপোষ করলেন না।
আপোষহীন এই মানুষটির সঙ্গে বঙ্গহিতৈষী বেথুন সাহেব একদিন নিজে উদ্যোগ নিয়ে মিত্রতা স্থাপন করলেন। সেই মিত্রতার পথে দু'জনেই নারীশিক্ষা প্রসারে অগ্রবর্তী হলেন। হেদুয়ায় দাঁড়িয়ে থেকে তৈরি করালেন স্কুলবাড়ি। মেয়েদের স্কুল। 'বেথুন বালিকা বিদ্যালয়'।
বিদ্যালয় তো হল। কিন্তু কেউই বাড়ি থেকে মেয়েদের এখানে পড়তে আসতে দিতে চাইলেন না। কেননা, হিন্দুবাড়ির শাস্ত্রীয় বিশ্বাস, লেখাপড়া শিখলে মেয়ে বিধবা হয়! আবার কারও ব্যক্তিগত বিশ্বাস, লেখাপড়া শিখলে মেয়েরা চরিত্রহীন হয়!
ওই দুই কু-বিশ্বাসের মাথায় বাড়ি মেরে মদনমোহন নিজের বড় দুই মেয়ে ভুবনমালা ও কুন্দমালাকে প্রথম বেথুন স্কুলে পড়তে পাঠালেন। তাঁর দেখাদেখি হাইকোর্টের বিচারপতি শম্ভুনাথ পণ্ডিত ও সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক তারানাথ তর্কবাচস্পতি আপন আপন মেয়েদেরও এই স্কুলে পাঠাতে শুরু করলেন। এঁদের দেখাদেখি আবার সাধারণ ঘরের মানুষও একে একে কুসংস্কার ভেঙে বাড়ির মেয়েদের এই স্কুলে পাঠাতে শুরু করলেন। ফলে, ক্রমে স্কুল জমে উঠতে শুরু করল। ব্যাপারটা এমন হল, যেন, চাঁদসদাগর প্রথম মনসা পুজো করার পর লোকসমাজে মনসার পুজো প্রচারিত হল।
মদনমোহনের চরিত্রে এই যে প্রশান্ত উদারতা ছিল, এটাই বেথুন সাহেবকে অত্যন্ত মুগ্ধ করেছিল। সেই মুগ্ধতা থেকেই তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে মদনমোহনের জন্য কিছু করতে চাইছিলেন। আর সেটা চাইতে গিয়েই মানুষটা যে কতটা নির্লোভী, তার পরিচয়ও তিনি পেয়েছিলেন :
মদনমোহন তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক। এই সময় একদিন কলেজের অধ্যক্ষের পদটি খালি হল। বেথুন সাহেব পদটি প্রিয় মদনমোহনকে দিতে চাইলেন। কিন্তু, মদনমোহন তা গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। বললেন, আমায় কেন সাহেব, দয়া করে আমার চেয়ে যোগ্যতম কাউকে এই পদে অধিষ্ঠিত করলে কলেজের ভালো হবে, সকলের ভালো হবে। আমার মনে হয় সাহেব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই পদের জন্য সবচেয়ে যোগ্য লোক।
বেথুন বন্ধুর কথা রাখলেন। ঈশ্বরচন্দ্রকেই ওই পদে বহাল করলেন। ছোট্ট ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনাটি শুধু নির্মোহী মদনমোহনকেই চেনায় না, তাঁর মহৎ-বন্ধুতার পরিসরটিকেও চিনিয়ে দেয়।
হ্যাঁ, বন্ধুত্বে মহানুভবতা তাঁর সত্যিই ছিলেন। তাই বন্ধু-বেথুনের সব অনুরোধ তিনি এড়াতে পারেননি। বেথুনের অনুরোধেই তিনি বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েদের জন্য তিনখন্ডে 'শিশুশিক্ষা' রচনার জন্য আবার কলম তুলে নিয়েছিলেন। যৌবনের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছিলেন। সহজ ছন্দে সুললিত ভাষায় লিখেছিলেন বর্ণচেনার প্রথম পুস্তকমালা।
বাঙালি মদনমোহনের 'রসতরঙ্গিনী' ভুলে গেছে, 'বাসবদত্তা' ভুলে গেছে, বালিকা বিদ্যালয় ভুলে গেছে, নারীশিক্ষা-বিধবা বিবাহের অবদান ভুলে গেছে, বারাসাত-কলকাতা তাঁর শিক্ষকতা ভুলে গেছে, মুর্শীদাবাদ-কান্দি তাঁর জজ-পণ্ডিতী ভুলে গেছে, তাঁর তৈরি অগুন্তি অনাথাশ্রম-বিদ্যালয়-দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কথা ভুলে গেছে; কিন্তু আজ দেড়শ বছর পেরিয়েও বাঙালি 'শিশুশিক্ষা'র একটি পাঠ আজও ভোলেনি। জন্মদাগের মতোই মনে রেখেছে :
"পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল।
কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল।।
শীতল বাতাস বয় জুড়ায় শরীর।
পাতায়-পাতায় পড়ে নিশির শিশির।।..."
আজও এই পাঠের মধ্য দিয়েই মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে নিরবধি আমাদের মধ্যে বেঁচে রয়েছেন; আর আমরা বাঁচিয়ে রেখেছি আমাদের ফেলে আসা শৈশবকে, এখনও...