‘সারাদিন পিয়ানোয়, প্রবীণ আঙুলগুলি, খেলা করে/ বহুদিন আগে তিনি এসেছেন, আমাদের এ শহরে’-
কবীর সুমন গান বেঁধেছিলেন তাঁকে নিয়ে। বাঙালি তাঁর মধ্যে আবিষ্কার করেছিল ম্যাজিক!
ধবধবে সাদা এক বৃদ্ধ। পিয়ানোর গায়ে আঙুল চলছে তরতরিয়ে। কী যে তার জাদু! কানে গেলেই ডুব। আমবাঙালীর মোৎজার্ট , বেঠফেন ছিল না, তাদের ছিল 'বালসারা'। ভি বালসারা। পুরো নাম ভিয়েস্তাপ আদের্শির বালসারা।
বাড়ি বোম্বাই। জাতিতে পার্শি। কিন্তু তিনি কায়মনে বঙ্গের। বাংলার। সুর তাঁর নেশা। সুরই তাঁর পরিচয়। বালসারা সাহেবের জীবন তাঁর বাজনার মতোই বর্ণময়। জীবন শুরু করেছিলেন ঘোড়ার গোসলদার হয়ে।
সে এক গল্প বটে। ম্যাট্রিক দিয়েই ঘর ছেড়েছিলেন কাজের খোঁজে। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত পুণে। মিলিটারি ক্যাম্পে ঘোড়ার আস্তাবলে কাজ জুটল একটা। ঘোড়াকে স্নান করাতে হবে রোজ। সেটাই চাকরি। দিনে কাজ আস্তাবলে। রাতে স্টেশনে। বেশ কাজ বলে শুরু করলেও এ কাজ কিন্তু চলল না বেশিদিন। শেষ পর্যন্ত ঘরের ছেলে ঘরে। নানা রকম কাজ করেছেন জীবনে। সব অভিজ্ঞতাই যেন তৈরি করেছিল তাঁকে।
গান জীবনের শুরুটা একেবারে ছোটবেলায়। মা নাজাময়ি'র কাছে রোজ চলত গানের ক্লাস। বাবা বিদেশি ভাষা শেখাতেন। ফ্রেঞ্চ, পার্সি, জার্মান ভাষার সায়েন্স টিউটোরিয়াল স্কুল ছিল। সেখানে মিউজিকের ক্লাসও হত।
বাড়ি ফিরে আসার পর পার্সি বিয়ে বাড়িতে জ্যাজ বাজাতে শুরু করেন। কলকাতায় আসা তার একটু পরে। কলকাতায় এসে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গে দেখা করলেন। তারপর অন্য জীবন। গান আর সুর ছাড়া আর কিছু নেই। আর ছিল বেদনা।
স্ত্রী পুত্রদের হারিয়ে ছিলেন অবেলায়। সুর আঁকড়ে মেনে নিয়েছিলেন সেই শোক। আর রবীন্দ্রনাথ। পিয়ানো, স্যাক্সোফোনের মতো বাজনা ছাড়াও গ্লাস, শিশি, ধাতু, পাথর, ঘণ্টি থেকে সুর তৈরি করতে পারতেন। ইঁট, কাঠ, পাথর যা বলবেন তাই থেকেই বের করে আনতে পারতেন সুর। যন্ত্রসঙ্গীতের জাদুকর তিনি। টাইপরাইটারে খটাখটকেও বদলে দিতে পারতেন সুরে।
বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে চল্লিশের বেশি ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন, প্রায় একশো বারোটি বাংলা ছবির সঙ্গীত আয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে উনিশটির আবহসঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। সেও এক সিনেমার গল্প।
গান পাগল যুবক প্রায় এক কাপড়ে এসেছিলেন কলকাতা। পকেটে তিন টাকা। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গে দেখা করলেন। তারপর অন্য জীবন। গান আর সুর ছাড়া আর কিছু নেই। আর ছিল বেদনা।
বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে চল্লিশের বেশি ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন, প্রায় একশো বারোটি বাংলা ছবির সঙ্গীত আয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে উনিশটির আবহসঙ্গীত পরিচালক ছিলেন।
মধ্য কলকাতায় তাঁর বাড়িতে আসতেন লতা মঙ্গেশকর, মহম্মদ রফি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে নয়! সরস্বতীপুজো হত ধুমধাম করে। জন্মসূত্রে পার্সি হয়েও হয়ে গিয়েছিলেন ভরপুর বাঙালি। ১৯৫৩-তে পা রেখেছিলেন তিলোত্তমায়, আমৃত্যু তিনি এই শহরের বাসিন্দা হয়ে থেকে গিয়েছিলেন। বাঙালিও বালসারা সাহেবকে ‘বাঙালি’ ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারেনি। তাঁর জন্ম ১৯২২ সালের ২২ জুন। শতবর্ষে পেরিয়ে তিনি আজ অমর বাঙালির হৃদয়ে।