ডিরোজিও হিন্দু কলেজের একজন অসম্ভব ছাত্রপ্রিয় শিক্ষক। তবু তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হল। রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে স্কুল পরিচালন সমিতির পক্ষ থেকে তাঁকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। দশ জনের সমিতিতে ডিরোজিওর পক্ষে ছিলেন মাত্ৰ দু'জন। এইচ এইচ উইলসন এবং ডেভিড হেয়ার। কিন্তু তাঁরা ডিরোজিওর সপক্ষে একটাও কথা বললেন না। একুল-ওকুল কাউকেই চটাতে চাইলেন না। পরে, মিষ্টি সান্ত্বনায় ডিরোজিওর মন রক্ষা করলেন। আসলে, এই সভায় ডিরোজিওকে ডাকা হয়নি। এমনকি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেওয়া হয়নি। ফলে, সম্ভ্রম রক্ষার খাতিরে ডিরোজিও পদত্যাগ করলেন। সেটা, ২৫ এপ্রিল ১৮৩১ সাল। আচ্ছা, ডিরোজিও-র বিরুদ্ধে অভিযোগটা কি?
অভিযোগ? অনেক। 'ডিরোজিও' পদবী। পুরো নাম, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। বংশধারায় আংলো-ইন্ডিয়ান, জন্ম ও কর্মসূত্রে বাঙালি। কলকাতার মৌলালিতে জন্ম। ১৮ এপ্রিল, ১৮০৯ সালে। অত্যন্ত মেধাবী এই মানুষটি মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই শিক্ষা শেষ করলেন। তারপর নানান কাজের অভিজ্ঞতা পেরিয়ে হিন্দু কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন ১৮২৬ সালে, সেও মাত্র সতেরো বছর বয়সে। ছাত্র হিসেবে পেলেন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ সিকদার, রামতনু লাহিড়ী, শিবচন্দ্র দেব, দিগম্বর মিত্র প্রমুখদের।
ছাত্ররা সকলেই প্রায় তাঁর সমবয়সী। ফলে, শিক্ষকের চেয়ে বন্ধু হয়ে উঠলেন তিনি। সুবিধে হল পারস্পরিক মুক্তমনের প্রকাশ এবং বিকাশে। প্রচলিত নিয়মে দরজা বন্ধ করে ক্লাস হতে লাগল ঠিকই, কিন্তু বদ্ধ ক্লাসেই তিনি বইয়ে দিলেন মুক্তচিন্তার বাতাস। আর এই শিক্ষাদানকে তিনি শুধু ক্লাসেই আটকে রাখলেন না। তাঁর বাড়িতে জমে উঠল অনুসন্ধিৎসু ছাত্রদের আড্ডা। ক্লাসে যা আলোচনা করা যায় না, তাই হল তাঁদের আলোচনার বিষয়। দর্শন ও ইতিহাসে ডিরোজিওর অবাধ পাণ্ডিত্য। তাঁর কাছেই লক, রীড, স্টুয়ার্ট-এর দর্শন এবং হিউমের যুক্তিবাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন ছাত্ররা। আলোচনায় স্থান পেতে লাগল স্বদেশপ্রেম, ঈশ্বর, পৌত্তলিকতার অসারতা। এসব বিষয়ে যুক্তি দিয়ে মতামত প্রকাশের জন্য আয়োজন হতে লাগল বিতর্কসভার। এই বিতর্কসভাকে স্থায়ী রূপ দিতে ১৮২৮ সালে বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করলেন 'একাডেমিক এসোসিয়েশন'। এভাবেই প্রথম নিয়মিত আলোচনা ও বিতর্কের জন্য গঠিত হল একটি সংগঠন। তর্কপ্রিয় বাঙালিকে যুক্তির আলোকে জাগিয়ে তুলতে শুরু করলেন ডিরোজিও। তাঁকে এবং তাঁর ছাত্রদের বলা হতে লাগল, 'নব্যবঙ্গ' বা 'ইয়ং বেঙ্গল'।
ডিরোজিওর এই ছাত্রপ্রীতি; তাঁর বাড়িতে ছাত্রদের যাতায়াত স্কুল কর্তৃপক্ষ মোটেই ভালো চোখে দেখলেন না। অনেক শিক্ষকের দারুণ ঈর্ষা হল। এর প্রমাণ পাওয়া গেল, পঠনপাঠনের মাসিক রিপোর্ট দিতে যাওয়ার সময়। প্রধান শিক্ষক ডি আনসেলমে। তাঁর কাছে রিপোর্ট নিয়ে গেলেন ডিরোজিও। কিন্তু, রিপোর্ট দেখে আনসেলমে বুঝলেন, ডিরোজিও ছাত্রদের বাঁধাধরা ছকের বাইরে পড়াচ্ছেন; অমনি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ডিরোজিওকে ঘুঁষি মারতে গেলেন! অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন ডিরোজিও, । অভিযোগ জানালেন পরিচালন সমিতিতে। আনসেলমেও পাল্টা অভিযোগ জানালেন যে, ডিরোজিও নাকি পড়া তৈরির নাম করে প্রায়ই তাড়াতাড়ি স্কুল থেকে চলে যান! অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগের পালা হয়তো এভাবেই চলতো। কিন্তু শেষমেশ মিটমাট হল পরস্পর ক্ষমা চাওয়ায়। বাইরে মিটমাট হল, তবে ভেতরের তিক্ততা মিটল না।
ডিরোজিও এবং তাঁর ছাত্রদের ভালো চোখে দেখলেন না 'গেল গেল'-বাদী হিন্দুরাও। তাঁদের ধারণা হল, ফিরিঙ্গি ডিরোজিও এসব করে নিশ্চয় ধর্মান্তরিত করার মতলব আঁটছেন! কারণ, তাঁর 'সঙ্গ' যাঁরা করছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই হিন্দুর ছেলে! বৃন্দাবন ঘোষাল নামের এক বজ্জাত বামুন রটিয়ে বেড়াতে লাগল--ছেলেরা ডিরোজিওর বাড়ি যায় তাঁর বোন এমিলিয়ার আকর্ষণে! আর দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তো তাঁর বিয়ে নাকি ঠিক হয়েই রয়েছে! এসব গুজবে হিন্দুরা ক্ষেপতে লাগল আরও। তাই যখন ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৩০ সালে সমাজ-ধর্ম-শিক্ষা-সাহিত্যমূলক মুক্তচিন্তার ইংরেজি সাপ্তাহিক 'পার্থেনন' প্রকাশিত হল; এক সংখ্যার বেশি পত্রিকাটিকে চলতেই দেওয়া হল না। তবে, অল্পায়ু এই পত্রিকাটি এদেশের লোকের সম্পাদনা ও মালিকানায় প্রকাশিত প্রথম ইংরেজি পত্রিকা।
ডিরোজিও কখনোই তাঁর ছাত্রদের কাছে খ্রিস্টধর্মের প্রচার করেননি, ধর্মান্তরিত হতেও বলেননি। তাঁর ছাত্ররা স্বেচ্ছায় কেউ খ্রিস্টান হয়েছেন, কেউ ব্রাহ্ম হয়েছেন, কেউ বা গোঁড়া হিন্দু। তিনি প্রচলিত সংস্কারকে যুক্তি দিয়ে বিচারের শিক্ষা দিয়েছিলেন। বাঙালির সমাজ-জীবনের সংস্কার ও ঐতিহ্য আষ্টেপৃষ্ঠে ধর্মের বাঁধনে বাঁধা, সেসব বিচার করতে গিয়ে তাই আঘাত লাগল ধর্মের গায়েই। ফলে ধর্মধ্বজিরা ক্ষুব্ধ হলেন। তাঁর তরুণ ছাত্রদের মেধা ছিল যথেষ্ট, কিন্তু সংস্কারক রামমোহন বা বিদ্যাসাগরের মতো তাঁরা স্থিতধী ছিলেন না। পাউরুটি, বিস্কুট, চা, গো-মাংস প্রভৃতি হিন্দুদের কাছে যেগুলো কুখাদ্য, সেগুলো খাওয়ার মধ্যেই মুক্তি লুকিয়ে আছে এমনকথা ডিরোজিও কখনোই বলেননি। অথচ সস্তা জনরঞ্জনের পথটিকে বেছে নিয়ে এসবই করে বেড়াতে লাগলেন তাঁরা। সে যেন এক নেশা। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি ডিরোজিও।
১৮৩১ সালের আগস্ট মাস। কৃষ্ণমোহনের বাড়িতে বন্ধুরা গোমাংস আনিয়ে ভোজন করলেন। শুধু তাই নয় হল্লা করে পাশের ব্রাহ্মণ বাড়িতে হাড় ফেলে ভাবলেন দারুণ রিফর্ম করলেন! উল্টে কেলেঙ্কারি হল। কৃষ্ণমোহনকে বলা হল, থাকতে গেলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, নইলে বাড়ি ছাড়তে হবে। কৃষ্ণমোহন বাড়ি ছাড়লেন।
ধর্মপ্রচারের জন্য ১৮৩০-এর ২৭ মে শিক্ষক-যাজক হয়ে কলকাতায় এসেছিলেন আলেকজান্ডার ডাফ। ইয়ংবেঙ্গলিদের এই হিন্দু-বিরোধিতার সুযোগে তিনি কাজ হাসিল করার ফিকির করলেন। হিন্দু কলেজের সামনে ধর্মপ্রচারের সেমিনার করলেন। তাতে ছাত্ররা যোগ দিলে হুলুস্থূল পড়ে গেল। উস্কানির মিথ্যে দায় বর্তালো ডিরোজিওর ওপর। ডাফের সাহায্যে কৃষ্ণমোহন খ্রিস্টান হলেন। এক্ষেত্রেও দায়ী হলেন ডিরোজিও।
প্রাচীন ও নবীনের যে সংঘাত সমাজে তৈরি হল, তাতে ইয়ংবেঙ্গলিদের অনেকের কাছেই বাড়ি বিষবৎ হয়ে উঠল। অনেকেই ঘর ছাড়তে চাইলেন। কিন্তু ডিরোজিও কখনোই চাননি, ঘরের ছেলে ঘর ছাড়ুক। এ বিষয়ে তাঁর মনোভাবটি উইলসনকে লেখা একটি চিঠি থেকে জানতে পারি : "প্রায় মাস দুই-তিন আগে দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জি... আমাকে জানান যে তাঁর প্রতি তাঁর পিতার ব্যবহার একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছে এবং একমাত্র পিতৃগৃহ ত্যাগ করলে তিনি মুক্তি পেতে পারেন। যদিও আমি জানতাম যে, তিনি যা বলছেন তা সত্যি , তাহলেও আমি তাঁকে নিবৃত্ত করি এই বলে যে মা-বাবার অনেক কিছুই সহ্য করতে হয় এবং তাড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে জগৎ সংসার তাঁর ব্যবহার সমর্থন করবে না।"
তবু দোষের কাঁটা তাঁর মুকুট ছাড়ল না। ইতিমধ্যে পদত্যাগ করলেন, জীবনও সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল। কলেরা তখন দুরারোগ্য রোগ। তাতেই মারা গেলেন তেইশ বছর বয়সে। ডিরোজিওর জীবনীকার ম্যাজ তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে একটি অদ্ভুত গল্প শুনিয়েছেন:
ডিরোজিওর এক ছাত্র একবার নাকি এক সন্ন্যাসীর কাছে তাঁকে নিয়ে যান। সন্ন্যাসী নাকি বলেছিলেন যে, ডিরোজিওর নামে যতগুলো বর্ণ, ততদিন তিনি বাঁচবেন। Henry Louis Vivian Derozio-তে তেইশটি বর্ণ আছে এবং তিনি তেইশ বছর বয়সে মারা যান। ব্যাপারটা নিতান্তই কাকতালীয়। ডিরোজিও তেইশ মারা গেছেন, কিন্তু তাঁর ভাইবোনেরা মারা গেছেন তেইশের আগেই।
যে মানুষটা মুক্তচিন্তায় সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন, যিনি ছিলেন ছাত্রদের এত প্রিয়, যাঁর ছাত্ররা প্রায় সবাই পণ্ডিত; তাঁরা কেউ তাঁর একটা জীবনী লেখেননি, পত্রিকায় ছড়ানো লেখাগুলো সংগ্রহ করে প্রকাশ করেননি; বাৎসরিক স্মরণ করেননি, মানুষটাকে ভুলেই গেলেন। মৃত্যুর পর স্মৃতিফলকের জন্য অর্থসংগ্রহ হলেও, সে টাকা নয়ছয় হয়ে যায়! সন্ন্যাসীর ভবিষ্যৎবাণীর চেয়ে এও কি কম আশচর্যের!
অনুবাদ ও তথ্যঋণ : হেনরি ডিরোজিও, তাঁর জীবন ও সময়--সুবীর রায়চৌধুরী