তারাশঙ্কর লিখেছিলেন জৌলুস হারানো এক জমিদার বাড়ির জলসাঘর কিভাবে নিভে যায় তারই কাহিনি।
অপু ট্রিলজি করার পর সত্যজিৎ রায় হাত দেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সেই গল্পে। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বিশ্বম্ভর রায়কে কেন্দ্র করে গল্প আবর্তিত হয়েছে।
সত্যজিৎ রায় অবশ্য মূল কাহিনী থেকে কিছুটা সরে গিয়েছিলেন। তিনি পরিবারের বদলে ধরতে চেয়েছিলেন সময়কে। যুগের সন্ধিক্ষণকে। বহমান সামন্ত শ্রেণির সঙ্গে বণিক শ্রেণির সংঘাত। উঠতি পুঁজির বিস্তার।
পর্দায় সামন্ত আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বম্ভর রায়। নাম ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস।
এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, বিশ্বম্ভর রায়ের ভূমিকায় ছবি বিশ্বাসকে না পেলে তিনি এই ছবি করতেন না। তিনি স্পষ্টই জানিয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস ছাড়া সম্ভব হত না ছবির রূপ দেওয়া।
‘জলসাঘর’ ছবির শুরুর গল্পটা কিন্তু শুরুতে একটু অন্যরকম ছিল। সত্যজিৎ এই ছবিতে চেয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস নয়, শিশির ভাদুড়িকে। কিন্তু তিনি সিনেমায় আসতে ছানি। সত্যজিতের ভাবনাকে সম্মান জানিয়েও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাঁর প্রস্তাব। তখন আসে ছবি বিশ্বাসের ভাবনা।
নিভে যাওয়া আভিজাত্যের শেষ শিখার তাত টুকু গায়ে লাগিয়ে তিনি বসে থাকেন আকাশের নিচে। ছাদ থেকে নদী দেখেন। সেই নদীতেই পাগলা ঝড়ের থাবা গ্রাস করেছে স্ত্রী আর শিশুপুত্রকে। এখন খাঁ-খাঁ রাজবাড়িতে তাঁর একা বাস। সঙ্গী বলতে পুরাতন দুই ভৃত্য। মাকড়সার জাল ছায়া ফেলে লুপ্ত গরিমার গায়ে। নিঝুমপুরীতে ঘুঘুর শব্দ। দরজা বন্ধ জলসাঘর। ঝাড়বাতি আলোহীন। সব গান স্তব্ধ। ঘুঙুরের শব্দ হারিয়েছে।
নদী ক্রমশ ধেয়ে আসে বিশ্বম্ভর রায়ের কোঠার দিকে। কখনও সে ফুঁসে উঠবে কেউ জানে না। স্থির হয়ে বসে থাকেন জমিদারমশাই। প্রজা রক্ষার দায়ভার কবেই হারিয়েছে, এখন শুধু মুহূর্ত গোনা।
রাজপাট হারানো বিশ্বম্ভর রায় আর ছবি বিশ্বাস মিলেমিশে গিয়েছিলেন পর্দায়। ছবির দর্শক আর সাহিত্যের পাঠক আলাদা করতে পারেনি দুজনকে। ‘ছবিবাবু’র অভিজাত চেহারা, রাশভারি চালচলন, জলদ গম্ভীর কণ্ঠ সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা ঘোর লাগায়। তিনি বাঙালি হয়েও ভীষণভাবে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছিলেন ছবিতে।
ডেরেক ম্যালকম বলেছেন সত্যজিতের ‘মোস্ট পারফেক্ট ফিল্ম’।
চিত্রনাট্য, কারিগরি, নির্দেশনা থেকে শুরু করে সঙ্গীত- সিনেমার সব দিকগুলোই তুমুল প্রশংসা পেয়েছিল সারা বিশ্বের সিনেমা সমালোচকদের কাছে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস একাই। প্রতি ফ্রেমে যেন তিনি নতুন আবিষ্কার। তা যেন দর্শকের মনকে দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করে দেয়।