নাগরিক জীবনের ফ্যাশন ট্রেন্ড উল্কি

বর্তমানে জেন-ওয়াইয়ের কাছে ট্যাটু বেশ জনপ্রিয়। হাতে, পায়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে কম-বেশি সবাইকে ট্যাটু করাতে দেখা যায়। শুধু জেন-ওয়াই নয়, বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যেও এখন ট্যাটু নিয়ে এক ধরণের উন্মাদনা দেখা যায়। ট্যাটু করানো শুধু খরচা সাপেক্ষ নয়, আঁকা বেশ যন্ত্রণাদায়ক বলে অনেকে মনে করেন। তারপরও ট্যাটুর জনপ্রিয়তায় কিন্তু বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়ে নি।

তবে ট্যাটু করানো নিয়ে বর্তমান সময়ে উন্মাদনা দেখা দিলেও এই পদ্ধতি কিন্তু নতুন নয়। ট্যাটু বা উল্কির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে উল্কি একটি প্রচলিত প্রাচীনতম রীতি। শরীরে বিভিন্ন ধরণের চিহ্ন ফুটিয়ে তোলাই হল উল্কি বা ট্যাটু। এক সময়ে আদিম সমাজে কোনও ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীকে সনাক্তকরণের একমাত্র উপায় ছিল উল্কি এবং আজও পৃথিবীর বহু জায়গার আদিবাসীদের মধ্যে এই প্রথাটি প্রচলিত রয়েছে।

কবে আর কিভাবে এই উল্কি প্রথা শুরু হয়েছে, তা নিয়ে বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে বিভিন্ন রকমের কাহিনি শোনা যায়। এই সব কাহিনির সঙ্গে শুধু ধর্ম নয়, তাঁদের বিশ্বাসও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। উল্কি নিয়ে এক এক জাতির মধ্যে এক এক রকমের গল্প রয়েছে।

https://www.thebetterindia.com/wp-content/uploads/2016/06/781px-Kutia_kondh_woman_3.jpg

ওঁরাও আদিবাসীর মধ্যে উল্কির উদ্ভব নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। “সৃষ্টিকর্তা ধরমেশ” প্রত্যেক মানুষকে ডাকলেন তাদের পেশা গ্রহণ করার জন্য। সবাই “সৃষ্টিকর্তা”র কাছে উপস্থিত হল। তিনি একজনকে লাঙল দিলেন, পরবর্তী সময়ে তার জীবিকা হল চাষী। একে একে কুড়ুল, জাল, কাপড় বোনার সুতো বিভিন্ন মানুষকে দিলেন। তারা যথাক্রমে কাঠুরে, জেলে এবং তাঁতি হয়। সবার শেষের ব্যক্তিকে দেওয়া হয় দোতারা।

দোতারা যাকে দেওয়া হয় তার সমাজে সম্মান অন্যদের থেকে বেশি। বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে বেড়ানোই তার পেশা। একদিন সে সন্ধ্যাবেলা ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। স্ত্রীর হাতের জঘন্য রান্না খেয়ে রেগে গিয়ে স্ত্রীকে মারধর করে। স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে মনের দুঃখে বনে চলে যায়।

মেয়েটির কান্না দেখে বনের এক দেবতার খুব কষ্ট হয়। সেই দেবতা মেয়েটিকে উল্কি আঁকা শেখায়। তারপর থেকে মেয়েটি উল্কি আঁকা শুরু করে এবং হয়ে ওঠে উল্কি শিল্পী। জন্ম নেয় উল্কি শিল্পের। যদিও এটা ওঁরাও জাতির বিশ্বাস।

https://i.pinimg.com/originals/9e/6c/38/9e6c381937d5083003441078f39d06bc.jpg

হাজং, দালুই, প্রভৃতি হিন্দু আদিবাসীদের বিশ্বাস আবার অন্য রকমের। তাদের সমাজে আবার অন্য কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। দেবতা বিষ্ণু স্ত্রী লক্ষ্মীকে বাড়িতে একা রেখে ঘুরতে যেতেন। লক্ষ্মী একদিন জানান একা বাড়িতে থাকতে তাঁর ভয় হয় এবং একা বাড়িতে অপদেবতারা তাঁকে ভয় দেখায়। সেই কথা শুনে বিষ্ণু তাঁর চক্র দিয়ে লক্ষ্মীর শরীরে আঁক কেটে দেয় এবং বলেন এই আঁক চিহ্ন দেখলে আর কেউ তাঁকে ভয় দেখাতে পারবে না। অনেকে মনে করেন এখান থেকে উল্কির উৎপত্তি। অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা পেতে হাজং এবং দলুই আদিবাসীদের মধ্যে উল্কি আঁকা শুরু হয়।

গোণ্ড জাতির মধ্যেও উল্কি নিয়ে এইরকম একটি গল্প রয়েছে। দেবাদিদেব মহাদেব একটি ভোজের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে উপস্থিত হলেন গোণ্ড জাতির দেবতা এবং তাঁর স্ত্রী। ভোজের খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর স্ত্রীকে ডাকতে গিয়ে গোণ্ড দেবতা ভুল করে দেবী পার্বতীর গায়ে হাত দিয়ে ফেলেন। তাতে দেবী পার্বতী রেগে যান। পার্বতী রাগ কমানোর জন্য উল্কি শিল্পীকে ডাকা হয়। দেবী পার্বতী শিল্পীকে নির্দেশ দেন, উল্কি এমনভাবে আঁকতে হবে যাতে সেটা দেখে সেই জাতি চেনা যায়।

https://lh3.googleusercontent.com/proxy/gu-DsNN0BHHz3ouy0popqkQwI0yIlKShbOOPEMTvVWcZvJQGbFvJ8zcjDFqeU9Nldr3Oi8QICpTI2MxVJ2HWAcy0Ro_eHN1ZrN6n6xaFUCxqfzmAQgxLY_pN9PHtIUDn1Qw0mVXRgugbP76qcr8L97ZEBp1MV8nqjoi-dubKaFthu99w3wZTZMBjKTKVN4Awkz5Vp0d-1ETb

উল্কি নিয়ে এরকম নানান কাহিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে এই কাহিনিগুলো থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট হয় যে উল্কি আসলে আদিবাসী সমাজের পবিত্রতার প্রতীক। শুধু পবিত্রতা নয়, কুনজর থেকে রেহাই পেতেও উল্কি আঁকা হয়। এছাড়া অপদেবতার কোপদৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতেও উল্কি আঁকা হত। আবার দৈহিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যও উল্কি আঁকা হয়ে থাকে।

আদিবাসী সমাজে ছেলে-মেয়েরা যৌবনে পা দিলেই উল্কি নেওয়া বাধ্যতামূলক। এ চিহ্ন দেখে বুঝতে হবে যে তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছে। সাঁওতাল আদিবাসীদের মধ্যে বারো-চৌদ্দ বছর বয়স হলেই উল্কি নিতে হয়। এই উল্কি নেওয়ার অর্থ হল তারা এখন বিবাহযোগ্য। আগে উল্কিবিহীন অবস্থায় বিয়ে করলে সাঁওতালী মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে গ্রহণ করা হত না। বর্তমানে অবশ্য এই নিয়ম কিছুটা শিথিল হয়েছে।

আমেরিকার মিসিসিপি অঞ্চলের নাৎচেজ আদিবাসী ছেলেদের যৌবন উৎসবই পালিত হয় উল্কি আঁকার মধ্যে দিয়ে। উল্কি আঁকা হয় নাকের উপর। উল্কির ঘা শুকিয়ে গেলে নাচ-গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে।নিউজিল্যান্ডের মাওরী এবং আফ্রিকার বিভিন্ন আদিমগোষ্ঠীর মধ্যেও একই কারণে উল্কির প্রচলন রয়েছে।

ভারতেও উল্কির ব্যবহার বহু প্রাচীন। ভারতীয় আদিবাসীদের মধ্যে এর প্রচলন প্রায় সর্বজনীন। এক সময়ে ব্রাহ্মণ পরিবারের নব-বধূদের উল্কি ধারণ করানো প্রায় একধরণের ধর্মীয় সংস্কার ছিল।

উল্কি সাধারণত আঁকা হয় হাতের তালু, কব্জি, বাহু, বুকে, পিঠে, কপালে এবং গলাতেও। উল্কির বিষয়বস্তু কিন্তু বিভিন্ন রকমের হতে পারে। লতাপাতা, চাঁদ, সূর্য, তারকা, গোলাকার, পশু-পাখি ইত্যাদি। উল্কি শিল্পীদের “খোদনি” বলা হয়। আগে খোদনি'রা গাছের কষ, হলুদ বাটা, পোড়া মাটি, নারীর স্তনদুগ্ধ প্রভৃতি মিশিয়ে কালি তৈরি করে সূঁচ, মাছের কাঁটা, গাছের কাঁটা প্রভৃতির সাহায্যে উল্কি আঁকত।

https://www.thesun.co.uk/wp-content/uploads/2017/04/nintchdbpict000313713644.jpg

এছাড়া ছুরির সাহায্যেও চামড়ার কোন জায়গায় চিহ্ন বা চিত্রটি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কেটে ফুটিয়ে তোলার পর কাটা জায়গায় রঙিন পাতার রস ইত্যাদি মাখিয়ে উল্কি আঁকা হত। ক্ষত নিরাময় হলে উল্কির চিহ্ন ফুটে উঠত। কাজল এবং কাঠকয়লার গুঁড়োও ব্যবহার করা হত বলে জানা যায়।

চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন উল্কি আঁকালে শরীরে নানারকম চর্মরোগ হতে পারে। তবে আদিবাসী সমাজে শরীরের কোন অংশের গ্ল্যান্ড বাড়তে থাকলে উল্কি ব্যবহার করা হয়। গ্ল্যান্ড চিকিৎসা পদ্ধতি আকুপাংচারের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেদিক থেকে বিচার করলে আদিবাসীদের এই প্রাচীন উল্কি প্রথাও ভাববার দাবি রাখে।

বর্তমানে উল্কির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। আধুনিক সময়ে উল্কি আঁকার জন্য বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রের ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে উল্কি আঁকার ক্ষেত্রে ভেষজ জিনিস ব্যবহার করা হত। এখন কৃত্রিম রঙের সাহায্য নেওয়া হয়। আগে এই শিল্প ছিল একটি গোষ্ঠীর রীতি। সেটা করানো বাধ্যতামূলক ছিল কিন্তু এখন দৈহিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য উল্কি বা ট্যাটু করানো হয়।

https://content.maltatoday.com.mt/ui_frontend/thumbnail/684/0/14_annie-spratt-gv1i7bylldi-unsplash.jpg

ট্যাটুর আকার, সময়, দেহের কোন স্থানে করা হবে এবং কি জিনিস ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে ট্যাটুর অর্থের পরিমাণ। আগে উল্কি করাতে গেলে অনেক কষ্টের সম্মুখীন হতে হত। এখন যন্ত্র ব্যবহার করার ফলে আগের থেকে কষ্ট কিছুটা লাঘব হলেও কেউ কেউ যন্ত্রণা পান বলেও জানা যায়। তবে তার সংখ্যা আগের তুলনায় নগন্য।

প্রাচীন অনেক শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে সেই শিল্পের চাহিদার অভাবে বা উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির জন্য। উল্কি কিন্তু বর্তমান সময়েও স্বমহিমায় বিরাজমান। শহরবাসী কিন্তু প্রাচীন রীতির বশবর্তী হয়ে ট্যাটু আঁকায় না। উল্কি আঁকানো বর্তমানে একটি শৌখিন ব্যাপার। আদিবাসী সমাজেও এখন উল্কি নিয়ে রীতি-নীতির গোঁড়ামি অনেকটা কমেছে। ধর্মীয় রীতি হিসেবে উল্কি শিল্প শুরু হলেও আধুনিক সময়ে এই শিল্পের মূল আবেদনের কারণ হল দেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি। সেটাই এই সময়ের নাগরিক সমাজকে আকর্ষণ করছে এবং তার ফলে জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...