মানুষের মন অনেক জটিল অংকের মিলিত উপন্যাস। পাওয়া, না - পাওয়া মিলেমিশে সেখানে হতাশা, অবসাদ, আনন্দেরা নিজেদের মতো জাল বুনতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মন যদি একঘেয়েমির খোলস ত্যাগ না করতে পারে, অচিরেই সেখানে বাসা বাঁধে বিষন্নতা। তখন এসব থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে আমাদের জীবন। বেড়াতে যাওয়া এ বিষয়ে এক ঝলক টাটকা বাতাস। শীতলপাটির মত। ভ্রমণের স্নিগ্ধতায় মন ও জীবন হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ। মলিনতা মুক্ত হয় অনুভূতিরা। ব্যস্ততার দড়ি টানাটানিতে মুহূর্তেরা গুটি-সুটি মেরে অপেক্ষায় থাকে সোনার কাঠির ছোঁয়ার। ভ্রমণ যেন সেই পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্র। সে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যায় রূপকথার দেশে। সেই রূপকথার দেশ হয়তো আমাদের খুব কাছের কোন সবুজে ঘেরা জায়গা। অথবা দূরের পাহাড় সমেত অনেকখানি আকাশ। আমাদের মনের আকাশের মেঘ সরানোর চাবিকাঠি থাকে বেড়াতে যাওয়ার জিম্মায়। সব সময় বেড়াতে যাওয়া কিন্তু কোন সুদূরে পাড়ি দেওয়া নয়। ঘরের কাছের শিশির বিন্দুতেও সেই সুখ পাওয়া যায়।
ভ্রমণপ্রেমী মানুষেরা বেড়াতে যাওয়া ভালোবাসেন নানা কারণে। কারোর কাছে প্রকৃতি মূল আকর্ষণ। তাই বেড়াতে গিয়েও একমুহুর্ত বিশ্রামের আওতায় থাকেন না এরা। সারাক্ষণ প্রকৃতির সৌন্দর্য আবিষ্কারের নেশায় ছুটে বেড়ান। একঘেয়ে জীবনে হাঁপিয়ে উঠে প্রকৃতির কোলে জিরিয়ে নিতে বেড়াতে যায় আবার কেউ কেউ। এরা পরিবেশকে উপভোগ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে। ছবি তোলা, খাওয়া - দাওয়া, এমনকি সাজগোজ করাও লক্ষ্য হয় অনেকের বেড়াতে যাওয়ার জন্য। তবে উদ্দেশ্য যাই হোক ভ্রমণ প্রেমী মানুষরা মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে অনেকটাই স্বচ্ছ হন। এমনটা বলছে গবেষণা। যে সমস্ত শিশুরা ছোট থেকে ভ্রমণে অভ্যস্ত থাকে তারা জীবনের প্রতিকূলতাকে অনেক সহজেই মেনে নিতে শেখে। শিশু-মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক আদব - কায়দা এবং শৃংখলা শেখানোর জন্য বেড়াতে যাওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়। কমবয়সীদের মধ্যে হতাশার প্রবণতা বাড়ছে এখন। সেক্ষেত্রেও ভ্রমণ অন্যতম উল্লেখযোগ্য সমাধান। গবেষণায় দেখা গেছে ভ্রমণ প্রেমী মানুষদের মধ্যে প্রায় ৩৪% একা বেড়াতে যেতে পছন্দ করে। এমনকি যারা একাকীত্ব উপভোগ করেন, একাকীত্বকে নিয়ে বিলাস করতে পছন্দ করেন, তাঁদের কাছেও বেড়াতে যাওয়া ওষুধের মতো। পর্যটনক্ষেত্র পরিষেবা হিসেবেও যথেষ্ট সমাদরযোগ্য।
অর্থনীতির সঙ্গে ভ্রমণের সম্পর্ক বরাবরই খুব গভীর। আমাদের দেশের, এমনকি রাজ্যের অর্থনীতিও ভ্রমণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই মহামারীর থাবায় মানুষের মনের সঙ্গে সঙ্গে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে অর্থনীতিও। জীবন ও জীবিকা যে ঠিক কতটা একে অপরের পরিপূরক তার আদর্শ উদাহরণ বোধহয় ভ্রমণ। তবে ভ্রমণ অনেক ক্ষেত্রেই পরিবেশের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। মানুষের অবিমৃষ্যকারিতা ও অসচেতনতার মূল্য দিতে হয় প্রকৃতিকে। পরিবেশ দূষণের কারণ অনেক ক্ষেত্রেই ভ্রমণে স্বেচ্ছাচারিতা। এ বিষয়ে মানুষের আত্মসমালোচনার প্রয়োজন। প্রয়োজন আচার-আচরণে সংশোধনের। পরিবেশবিদরা এ বিষয়ে কিছু নির্দেশিকা জারি করে এই ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টা করে চলেছেন। তবে ভ্রমণ প্রেমী মানুষের সহযোগিতা ছাড়া এই পরিস্থিতি এড়ানো অসম্ভব। ভ্রমণ এর ফলে দূষিত পরিবেশ প্রভাব ফেলছে অর্থনীতিতেও।
ক্লিশে হয়ে যাওয়া জীবনের অস্তিত্ব অনুভব করতে ভুলে গেলে তাকে জীবন পথে ফিরিয়ে আনার অব্যর্থ ওষুধ বেড়াতে যাওয়া। অপুর সংসার সিনেমার সেই কালজয়ী সংলাপ। "জীবনে দারিদ্র, ট্র্যাজেডির অস্তিত্ব থাকা সত্বেও জীবনবিমুখ না হয়ে বেঁচে থাকাটাই আসল চ্যালেঞ্জ।" সেই চ্যালেঞ্জকে সাদরে অভ্যর্থনা করার জন্য ভ্রমণকে সঙ্গী করা এক আশ্চর্য টনিকের মতো কাজ করে।