ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙতে মনে হল আজ একটা লম্বা দিন। ব্রেকফাস্ট করে ঘর থেকে বেরব আর ঘরে ফেরা ডিনারের আগে।
বিছানায় শুয়েই মোবাইলে আরেকবার গবেষণা করে নিলাম কোথায় কী কী দেখার আছে। এর মধ্যে দেখি ম্যাডামও ঘুম থেকে উঠে বসে গা ভাঙছেন। এবার দিনের জন্য তৈরি হওয়ার পালা।
সকাল সাতটায় যখন ব্রেকফাস্ট টেবিলে এলাম তখন আর কেউ সেখানে নেই। এই ইউথ হস্টেলে ব্রেকফাস্ট তেমন তাগড়া নয়। দু’মাস আগে সুইটজারল্যান্ড বেড়াতে আসার যখন পরিকল্পনা করছি তখন সস্তার জায়গা খুঁজতে গিয়ে এই ইউথ হস্টেলের সন্ধান পাই।
স্টেশনের কাছে ভিড়ের জায়গায় ১৪০ সুইস ফ্র্যাঙ্কের নীচে কোন ঘর পাচ্ছিলাম না, তখন এত সুন্দর একটা লোকেশনে নিরিবিলি এলাকায় ১১৫ ফ্র্যাঙ্কে ঘর পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। আর তখন এটাও জানতাম ব্রেকফাস্ট সাধারণ মানেরই হবে।
এই ইউথ হস্টেলের দু’দিকে দু’টো রেলওয়ে স্টেশন। জ্যুরিখ লেকের ধারে ওলিশফেন স্টেশনে এসে থালউইলের ট্রেনে চড়লাম। বাঁদিকে জ্যুরিখ লেকের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে মিনিট সাত আট পর থালউইল পৌঁছলাম। লেকের দু’দিকে হেমন্তের লাল হলুদ সবুজ রঙের বাহার দেখতে দেখতে সিদ্ধান্ত নিলাম এই লেকে একদিন ক্রুইজে ঘুরতে হবে। থালউইল থেকে ল্যুজার্ন পৌঁছতে ট্রেনে আধঘণ্টা মত লাগে। পথে জুগ শহর পেরিয়ে যুগ লেকের পাশে খানিকক্ষণ দৌড়ল। দু’পাশের সৌন্দর্য্যে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। তখন কি জানি যে সামনে যেসব জায়গা আসবে তার কাছে এ কিছুই না!
ল্যুজার্ন শহর অনেকবার গেছি। কিন্তু বারবার যাওয়া যায় এখানে। স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়েই সামনেই দেখা যায় শহরের মুখ্য আকর্ষণ চ্যাপেল ব্রিজ। কাছেই একটা চ্যাপেল থাকায় এমন নাম। কাঠের এই ব্রিজটা চতুর্দশ শতাব্দীতে তৈরি। এই ব্রিজে কাঠের উপর অনেক মিনিয়েচার পেন্টিং আছে। ১৯৯৩ সালে বিধ্বংশী অগ্নিকাণ্ডে ব্রিজের সাথে ওই ছবিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে অনেক মেহনত করে ব্রিজের সাথে কিছু ছবিকেও পুনর্জীবন দেওয়া গেছে। এই ব্রিজটা পেরোলেই ওল্ড টাউন।
পুরনো ল্যুজার্নের স্থাপত্য দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখি একটা গাড়ি এসে রাস্তার মাঝে থামল।
কি ব্যাপার?
এ দেশে তো এ’ভাবে কেউ গাড়ি দাঁড় করায় না! দেখি গাড়ি থেকে একটা প্ল্যাটফর্ম ক্রমশ উপরে উঠছে, তার উপর দাঁড়িয়ে একজন। রাস্তার উপরে একটা বিরাট আকারের ঝাড়বাতি গোছের কিছু লাগানো ছিল, সেটাকে খুলে প্ল্যাটফর্মের উপর রাখলো, প্ল্যাটফর্ম নীচে নেমে এল, গাড়িটা রাস্তা দিয়ে সামনের দিকে চলে গেল।
পুরো অপারেশনটা মিনিট তিনেকের, আমরা ভাবতেই পারি না। এই পুরনো শহরের মধ্যেই খানিকটা গিয়ে একটা পাথরে খোদাই করা মুমূর্ষু সিংহের মূর্তি। ১৯৭২ সালে তৈরি এই খোদাই দেখতে অনেক দর্শকের জমায়েত ঘটে।
ল্যুজার্ন শহরের চ্যাপেল ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে পাহাড় ঘেরা এই শহরটার চার দিকের সৌন্দর্য দেখেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো যায়। সেই সৌন্দর্য্যের আকর্ষণেই এই শহরটা এই দেশের সবচেয়ে বড় ট্যুরিস্ট আকর্ষণ।
ল্যুজার্ন শহরের কাছেই আল্পসের অনেকগুলো চূড়া আছে, যেমন মাউন্ট রিগি, মাউন্ট পিলাটুস। সেগুলোর জন্য ভ্রমনার্থীরা ল্যুজার্ন থেকে যাত্রা শুরু করে। লেক ল্যুজার্নে নৌকাবিহার করেও চারদিকের পাহাড়ের সৌন্দর্য্যের পুজো করেন অনেকে। তবে এবার আমাদের উদ্দেশ্য আলাদা।
আজ গোল্ডেন পাস রুটের প্রথম ধাপ যাত্রা করার জন্য এসেছি। ১০ টা বেজে ৫ মিনিটে শুরু হবে ইন্টার লাইকেন এক্সপ্রেসে সেই যাত্রা। সময় হয়ে এসেছে, কাজেই যাওয়া যাক স্টেশনের দিকে। সুইজারল্যান্ড ঘড়ির দেশ, এদের দেশে ট্রেনও চলে ঘড়ির কাঁটার মত, এক মিনিটের এদিক ওদিক দেখি নি কোন দিন।
ক্রমশ: