আজকের ট্রেন যাত্রা ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের, গোল্ডেন পাস রুটের বাকি পথটা মানে মনট্রিয়ক্স পৌঁছতে আরো ঘণ্টা চার লাগে। আর তার জন্য তিনবার ট্রেন বদল করতে হয়।
ট্রেন চলতে শুরু করার কয়েক মিনিটের মধ্যে বুঝেছিলাম গোল্ডেন পাস কেন বলে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরা এই রাস্তায় সব ঋতুতেই ট্যুরিস্টদের ভিড় থাকে।
ঋতুবদলের সাথে সাথে এই পথের দু’ধারের রূপ বদল হয়, কিন্তু প্রত্যেকটা রূপই মানুষকে টেনে আনে। আমরা হেমন্তের রঙের খেলা দেখতে এসেছি। ট্রেনের যাত্রীরা বেশির ভাগই বিদেশী, আমার মতই গোল্ডেন পাস রূটের রূপদর্শনে এসেছেন। যথারীতি বিদেশীদের মধ্যে সিংহভাগ জাপানী।
স্টেশন থেকে বেরনোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাঁদিকে ল্যুজার্নের লেক দেখা গেল। তারপর মিনিট পনেরো ধরে ওই লেকের সঙ্গে লুকোচুরি চলতে থাকল। ডানদিকে পাহাড় উঠে গিয়েছে, ওখানেই আছে মাউন্ট পিলাটুস।
খানিক পরে অল্পনাখস্টাড স্টেশন পেরনোর সময় ডানদিকে দেখি পিলাটুসে ওঠার ট্রেনলাইন। এই কগহুইল ট্রেনে ২.২ কিলোমিটার রাস্তা পার করে ৩০ মিনিটে পৌঁছনো যায় প্রায় ২০০০ মিটার উচ্চতায়। পিলাটুসে যাওয়ার রোপওয়েও আছে, তবে সেটা পাহাড়ের অন্য দিকে ক্রিয়েন্স স্টেশন থেকে যেতে হয়।
অল্পনাখস্টাডেই ল্যুজার্নের হ্রদকে বিদায় জানালাম। তবে এর পর ডানদিকে একের পর এক লেক এসেছিল। আমরা ডানদিক বাঁদিক দুটো দিকেই মাথা ঘোরাচ্ছিলাম। আমাদের ট্রেনের কোচগুলো ছিল প্যানোরামা টাইপ, মানে, বিরাট সাইজের কাঁচের জানালা যাতে বাইরের প্রকৃতির সৌন্দর্য্য বিনা বাধায় উপভোগ করা যায়। দু’পাশে অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য। বৌয়ের ভাষায় সবই তো ক্যালেন্ডার। 'ছবির মতো' কথাটা বোধ হয় এই জায়গা দেখেই কেউ প্রথম বলেছিল।
হেমন্তের রঙে দু’দিকের গাছেরা সেজে উঠেছে। মাটি দেখা যায় না, ঘাসের কার্পেট বিছনো। সরনেন স্টেশনে ট্রেন পৌঁছল, ডানদিকে সরনেনসি বা সরনেন লেক। বাঁদিকে দুরে বরফ ঢাকা পর্বতশৃঙ্গের সারি দেখা যাচ্ছিল, ওরই কোন একটা বোধ হয় মাউন্ট টিটলিস।
সরনেনের পরে কয়েকটা স্টেশন পার হয়েই এল লুংগার্ন লেকের ধারে লুংগার্ন স্টেশন। এখান থেকে শুরু হল প্রায় ১০০০ মিটার উচ্চতায় ব্রুয়েনিগ পাসে ওঠা। তারপরই আবার নিচে নামার পালা। এই পর্বে ট্রেনের গতিবেগ অনেক কমে যায়। তাই ল্যুজার্ন থেকে ইন্টারলাকেন এই ৫৫ কিলোমিটার রাস্তা পার হতে এক ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট লাগে।
মেরিংগেন স্টেশনের কাছেই রাইখেনবাখ জলপ্রপাত। প্রফেসর মরিয়ার্টির হাতে শার্লক হোমসের মৃত্যু হয়েছিল এখানেই (The final problem)। পরে অবশ্য পাঠকদের দাবিতে কোনান ডয়েল শার্লক হোমসকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। এখানে একটা শার্লক হোমস মিউজিয়ামও আছে।
অনেকবারই এই জায়গার আশপাশ দিয়ে গিয়েছি, কিন্তু জায়গাটা দেখা হয় নি। এবারও হল না। মেরিংগেন থেকে শুরু হল লেক ব্রিয়েঞ্জের দিকে যাত্রা। এই পথটা আরে নদীকে বাঁ পাশে রেখে এগোতে হয়, নদীটা গিয়ে লেক ব্রিয়াঞ্জে পড়েছে, পরে সেখান থেকে লেক থুনে। তারপর আবার লেক থুন থেকে বেরিয়ে বার্ন শহরের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে।
এখন আমরা জুংফ্রাউ এলাকার কাছাকাছি। বাঁদিকে একের পর এক তুষারশুভ্র পর্বতচূড়া দেখা যাচ্ছে। অ্যারে নদীর অন্য পাড়ে প্রথমে সবুজ ঘাসের কার্পেট, তারপরই পাহাড়ের গায়ে লাল হলুদ রঙের গাছের দল, তার পিছনে ধবধবে সাদা পর্বতশৃঙ্গ, সে দৃশ্য ভোলার নয়। এতেই মগ্ন ছিলাম। হঠাৎ জার্মান ভাষায় একটা ঘোষণা হল, কয়েকজনের মধ্যে একটা নড়াচড়া দেখলাম। তারপরই ইংরাজিতে ঘোষণা, ‘লাইনে মেরামতির জন্য এই ট্রেন ব্রিয়েঞ্জ স্টেশনের পর আর যাবে না। যাত্রীদের বাকি রাস্তাটা বাসে যেতে হবে’।
মনে পড়ল ল্যুজার্ন স্টেশনে এ রকম একটা কি যেন লেখা ছিল, দেখেছিলাম, পাত্তা দিই নি। কি হবে ভাবতে ভাবতেই ব্রিয়াঞ্জ লেকের ধারে থেমে গেল ট্রেনটা। অনিশ্চিত যাত্রাপথ এবার। তবু তো নামতেই হয়, কিছু না হলে এই লেকে ক্রুইজে কাটাব খানিক সময়।
ক্রমশ: