স্মরণে গোডো - র রূপকার

নাটকের ক্লাস। আসন্ন সময়ের নামহীন এক শিশু নাট্যকার। পড়ছে নাটকের রূপভেদ। মাষ্টারমশাই একটা ছবি দেখাচ্ছেন। কালোর প্রেক্ষাপটে হলুদ চাঁদ।অ্যাবসার্ড। হ্যাঁ, শুধু এই একটা শব্দের মানেই সে খুঁজে বেরিয়েছে আজীবন। যা দেখার জন্য বন্ধ করতে হয় দুই চোখ, সেই ভিতরের দেখার মধ্যেই বাস অ্যাবসার্ডিসম -এর।

দুজন চরিত্র। ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন, বিযুক্ত ও বিপন্ন; নৈরাশ্যবাদী, আত্মধ্বংসকারী; দুঃস্বপ্ন ও বিভীষিকায় আক্রান্ত; যন্ত্রণাদগ্ধ, ব্যর্থ, পরাজিত। পার্থিব শৃঙ্খলের ঘেরাটোপে জর্জরিত দুজন। একটি নাটক যা বদলে দিয়েছিল চলতি ব্যাকরণ। এই নাটকে নেই কোনও ঘটনার ঘনঘটা, কোনও দ্বন্দ্ব-সংঘাত, টানাপোড়েন, চরিত্রের বিকাশ, ঘটনার ধারাবাহিকতা বা অগ্রসরতা।

চরিত্রগুলো শুধু অপেক্ষায়। এক অচেনা ব্যক্তির। তাঁরা অপেক্ষা করছেন কোনও এক গোডোর। এই অপেক্ষার মাঝে সময়ের ব্যবধান মাত্র একদিনের। অথচ এই এতটুকু সময় পার করতে গিয়ে তাঁদের মনে হয় এ যেন অনন্তকাল এর অপেক্ষা।পরপর দুদিন অপেক্ষার পর খবর আসে যে আপাতত উনি এসে উঠতে পারছেননা। আগামীকাল নিশ্চয়ই আসবেন! এই অনন্ত অপেক্ষা একসময় ব্যর্থতায় পরিবর্তিত হয়। এই অপেক্ষার অবসান হবে না। এই অপেক্ষার অবসান হয়না। গোডো কোনও দিনই আসেন না। আসলে সেতো মানুষেরই ভিতরের। অথবা জাগতিক নয় এমন এক ধী। তাঁকে খুঁজতে হয় নিরন্তর।

এই গোডো -কে তাঁরা চেনেননা, কোনও দিন দেখেননি। তাঁদের বিশ্বাস গোডোর আগমণেই লাঘব হবে তাঁদের যন্ত্রণা। ওয়েটিং ফর গোডো। রূপকার স্যামিউয়েল বেকেট। জীবন কেটেছে অস্থির দোলাচলে, কৃষ্টির সন্ধানে। একবার  মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ার অভিযোগে চাকরি গিয়েছিল কলেজের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেছে নিয়েছিলেন বিপজ্জনক জীবন। যোগ দিয়েছিলেন প্রতিরোধকারী শিবিরের এক গোপন বিভাগে। ছেলেবেলাতেই দেখে ফেলেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর রূপ। যৌবন কেটেছে যুদ্ধ-পরবর্তী অস্থিরতায়। তারপর আবার মড়কের ডাকে বেজেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা।

at

বুঝেছিলেন যুদ্ধই একমাত্র মহামারি। আর এর প্রতিষেধক হয় না। শুধুমাত্র নতুন কৃষ্টিই বয়ে আনতে পারে ক্ষণিকের সজীব আশ্বাস। যুদ্ধ। লাখের অঙ্কে লাশ। পৃথিবীর অস্তিত্ব সংকট। ক্ষমতার লালসা। টুকরো টুকরো ছেঁড়া অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি নাট্যকার, গল্পকার, লেখক, নির্দেশক। নৈরাশ্য তাঁর বরাবরের ছায়া সঙ্গী। দেশভাগের যন্ত্রণা ঋত্বিক ঘটক কে বাধ্য করেছিল যন্ত্রণার কাহন রচনায়। সেই যন্ত্রণাই এই নাট্যকার কে এনে দাঁড় করিয়েছিল তাঁর গোডো - র মুখোমুখি; যাঁকে দর্শক দেখতে পাননা, অনুভবে বুঝে নেন। আজীবন অন্তর্মুখীন, স্পর্শকাতর, অনুভূতিপ্রবণ, প্রচার-প্রত্যাশাহীন, নির্জনতাপ্রিয় এবং উদার। এড়িয়ে চলতেন সাংবাদিকদের পাছে অন্যের লেখা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে হয়।

১৯৬৯ সালে স্বীকৃত হলেন নোবেল সাহিত্য সম্মানের জন্য। প্রান্তিক মানুষদের নিস্তব্ধতা ভাষায় প্রকাশ করার কেতাবী খেতাব। যেমন প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পর আশানুরূপ সাড়া মেলেনি তেমনই পুরস্কার ঘোষণার পর কমিটির কাছে প্রস্তাব যায় তাঁর নাম বাতিলের। তাও রেহাই পান না তিনি! পুরস্কারের পদক যেন তাঁরই হাতের ছোঁয়া পাওয়ার অপেক্ষায় অধীর। মনে পড়ে যায় মৃত্যুর খবর জানান দেওয়া নিয়ে তাঁর ফ্যান্টাসির কথা।

মৃত্যুর চারদিন পর পৃথিবী জানতে পারে তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতির কথা। এমনটাই সাধ ছিল দ্য আননেমেবল এর লেখকের। লেখার ভাষা ও আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন গোটা জীবন ধরে। কখনও প্যারাগ্রাফ বর্জন তো কখনও যতিচিহ্ন। সর্বশেষ উপন্যাস স্টারিংস স্টিল মাত্র দু হাজার শব্দের! স্বল্পতম দৈর্ঘ্যের নাটক ব্রেথ মাত্র আধ মিনিটের এবং সংলাপ বিহীন।

আজও পৃথিবী অস্থির সময়ের শিকার। পৃথিবীর ঘড়ির কাটা স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। শুভ ক্ষণের প্রতীক্ষায় সকলে। আবার মানুষ বাইরে বেরিয়ে তাঁর সৃষ্টি সুখের উল্লাসে হারাতে চাইছে। অনিশ্চিত এই প্রতীক্ষার অবসানের সময়। আজ মঞ্চের সেই দুজন চরিত্রের মত আপামর মানবজাতিও প্রতীক্ষায়। তাঁরা অপেক্ষায় সেই কাল্পনিক গোডোর যাঁর আগমনে ঘুঁচে যাবে পৃথিবীর অসুখ। হেসে উঠবে প্রকৃতি তাঁর সন্তানের কলতানে। আজ সেই রুপকারের আবির্ভাব দিবস। এত বছর পার করেও তাঁর অভাব অনুভূত হয় যখনই গ্রাস করে অস্থিরতা, অচলাবস্থা।

শুভ জন্মদিন বাস্তবের গোডো।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...