‘পাকিজা’ ছবির অনুষ্ঠান চলছে। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। মাথায় ওড়না ঢাকা এক মহিলা এসে মালা দিলেন মন্ত্রীকে। সঙ্গের সাংবাদিককে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মেয়েটি কে?’।
লাজুক, অবনত চোখের মেয়েটিকে দেখে শাস্ত্রীজি ভাবতেই পারেননি, এই মেয়েটিই ছবির হিরোইন। যার বিষাদ দৃষ্টিতে ডুব দিলে আর ওঠা যায় না। গোটা দেশ ততোদিনে জেনে গিয়েছে এই সত্যি। মীনা কুমারী।
মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ‘পাকিজা’ ছবি পরিদর্শনে আসার জন্য। না করতে পারেন নি লাল বাহাদুর শাস্ত্রী।
সেই সময়েই ঘটনাটি ঘটে। লাল বাহাদুরের কথা শুনে খানিকটা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সেই সাংবাদিক। মীনা কুমারী তখন খ্যাতির তুঙ্গে। হিন্দি সিনেমার ‘ট্র্যাজিক কুইন’ নামে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন।
সেই অনুষ্ঠানে বহু সেলিব্রিটি এসেছিলেন ছবি এবং রাজনীতির জগতের।
লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মঞ্চে উঠে শুরুতেই তাঁর স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গীতে বলেছিলেন, ‘ মীনা কুমারীজি মুঝে মাফ কর না, ম্যায়নে আপকা নাম পহেলি দফা, শুনা হ্যায়।’
মীনা কুমারী দর্শক আসনে একেবারে সামনের সারিতে বসেছিলেন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর এহেন ক্ষমাপ্রার্থনায় প্রবল অস্বস্তিতে পড়ে যান।
১৯৭২ সালে ‘পাকিজা’ তৈরি হয়। কমল আমরোহীর পরিচালনায়। এ ছবি শেষ করতে ১৪ বছর লেগেছিলো। মীনাকুমারী আর কমলের স্বপ্ন ছিল এই ছবি।
ছবির কাজ প্রথম শুরু হয় ১৯৫৪-এ। তখন এই ছবি শুট করা হয়েছিল সাদা কালোয়।
মীনা কুমারী নার্গিস নামে লক্ষৌ-এর এক ‘তবওয়াইফ’- এর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
ছবিটির পরিকল্পনা করেছিলেন মীনা কুমারী ও কমল আমরহী নিজে। ১৯৬৪ সালে ভেঙে যায় তাঁদের দাম্পত্য। বন্ধ হয়ে যায় ছবির কাজ।
সম্পর্কের টানাপড়েন, অবসাদ, হতাশা ঘিরে ধরে মীনাকুমারীকে। অ্যালকোহলের নেশা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল। এমন জায়গায় দাঁড়ায় যে অসুস্থ হয়ে পড়েন অভিনেত্রী। লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে।
অসুস্থতার খবর শুনে প্রাক্তন স্ত্রীকে দেখতে আসেন কমল আমরহী। সেই সময়ই তিনি প্রস্তাব দেন নতুন করে পাকিজা শুরু করার।
অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও মীনা কুমারী রাজী হন কমলের প্রস্তাবে।
কেটে গিয়েছে দু’দশক। সাদা কালো যুগ পার হয়ে হিন্দি ছবির দুনিয়া তখন রঙিন। সাদা কালোয় শুট হওয়া সমস্ত অংশ বাতিল করে আবার নতুন করে শুটিং- এর পরিকল্পনা করা হল। সালটা ১৯৬৮। কমল এমজিএম থেকে কালার ফটোগ্রাফির জন্য লেন্সও আনান।
‘পাকিজা’ ছবি প্রথম শুরুর সময়ে যে ইউনিট ছিল বদল ঘটেছিল সেখানেও। ছবির আগের ইউনিটের চিত্রগ্রাহক জোসেফ বীরসিং এবং সুরকার গোলাম মোহাম্মদ মারা যান। সেই জায়গায় নওশাদ সুরকার হিসাবে যোগ দেন। ক্যামেরায় বলিউডের সেরা বারো চিত্রগ্রাহক । নাদিরা কিছু সমস্যার কারণে এ ছবি ছেড়ে দেন। কমল নতুন করে স্ক্রিপ্ট লেখেন এবং বীণা চরিত্রের সৃষ্টি করেন। শুরুতে ব্যবসায়ী সেলিম চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে অশোক কুমারকে নেওয়া হয়েছিল। পরে রাজকুমার এ চরিত্রের জন্যে রাজী হলে তার চেহারা ও ব্যক্তিত্বের কথা মনে করেই চরিত্রটিকে ব্যবসায়ী থেকে ফরেস্ট রেঞ্জারে বদলে দেওয়া হয়। অশোক কুমার শাহাবুদ্দিন চরিত্রে অভিনয় করেন।
১৯৬৪ সালে নতুন করে শুটিং শুরু হলে অনেকেই কমলকে বলেছিলেন, ছবির সঙ্গীতকে বদলে দিতে। কিন্তু কমল বলেছিলেন, ‘ ছবির পুরনো সুরকার গোমাল মোহাম্মদ বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো বদল আনতেন, কিন্তু তিনি এই ছবির জন্য যে ১২ টি গান সৃষ্টি করে গিয়েছেন, তা এতই অসাধারণ যে, সেই মানুষটির সঙ্গে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবেন না।’
পরে অবশ্য ছবির দৈর্ঘ্য কমাতে গানের সংখ্যা ১২ থেকে কমিয়ে ৬ করতে হয়েছিল।
চূড়ান্ত শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে দিয়ে ইনি ছবির কাজ সম্পূর্ণ করলেন।
১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বোম্বাইয়ের মারাঠা মন্দিরে ‘পাকিজা’ ছবির ফার্স্ট স্ক্রিনিং। পরনে সাদা ঘাঘরা। ছবি শেষ হতে কমলের হাত জড়িয়ে ধরেছিলেন পাকিজা ছবির হিরোইন। কমলের প্রাক্তন স্ত্রী। বলেছিলেন, ‘কথা দাও, ‘পাকিজা’র মতো ছবি তুমি আর কোনওদিন তৈরি করবে না।’
কিন্তু তিনি যে মীনা কুমারী, অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা তাঁর আজন্মের সঙ্গী। পাকিজা ছবি রিলিজ করল। প্রথম সারির সংবাদপত্রগুলো বেশির ভাগ সমালোচনায় বিরূপ।
মাস দুয়েক পর মারা গেলেন মীনা। মাত্র ৩৮ বছর বয়স তখন অভিনেত্রীর।
ইকবালবানু আলি বক্স এর দ্বিতীয় কন্যা মেহজাবিন বানু। যার জন্মের পর অনটনের জ্বালায় বেনামী অনাথ আশ্রমের দরজায় রেখে এসেছিলেন তাঁর বাবা। মৃত্যুর সময়ও কপর্দপশূন্য। নিঃস্ব।
হাসপাতালের বিল মিটিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু গুলজার।
প্রিয় অভিনেত্রীর শেষ কাজ হিসেবে ‘পাকিজা’ ছবিকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিল দর্শকরা। ছবি সুপারহিট।