সরস্বতী পুজোর ঐতিহ্যবাহী খাওয়া দাওয়া

বাঙালির পার্বণ মানেই খাওয়া দাওয়া। উৎসব থেকে পুজো সবেতেই খাবারের অনুষঙ্গ থাকবেই থাকবে। স্বভাবতই সরস্বতী পুজো তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতিবছর মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতী বন্দনা করা হয়। শীতের বিদায়বেলা এবং বসন্তের আগমনের সন্ধিক্ষণে নবরূপে সেজে ওঠে প্রকৃতি। বসন্ত পঞ্চমী বাঙালির নস্টালজিয়া, উত্তেজনার উত্‍সব। পুজোতে পেট পুজো তো হয়ই। ঈশ্বরের জন্য ফল নৈবেদ্য ভোগ সবই থাকে, সেই সঙ্গে স্কুলের খিচুড়ি বা পোলাও তো আছেই, কিন্তু অনেকেই মুখিয়ে থাকেন সরস্বতী পুজোর পরের দিন গোটা সেদ্ধ খাওয়ার জন্য। আসলে আমরা বাঙালিরা খাওয়া দাওয়াকেই পুজো বানিয়ে ফেলেছি।

বাংলায় বছরে দুবার অরন্ধন উৎসব পালিত হয়। তার মধ্যে একটি হয়, মাঘ মাসে সরস্বতী পুজোর পরের দিন শীতলষষ্ঠীতে শিলনোড়া পুজোর দিন। মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে জ্ঞান, বাণী এবং শিল্পের দেবী মা সরস্বতীর আরাধনা হয় সর্বত্র। এই পুজোর পরের দিন ঘরে ঘরে পালিত হয় শীতল ষষ্ঠী। সন্তান ও সংসারের মঙ্গল কামনায় বাড়ির মহিলারা এই ব্রত পালন করেন। ব্রত ভঙ্গ ভাঙা হয় গোটা সেদ্ধ খেয়ে। সরস্বতী পুজোর পরের দিন প্রতিটি বাঙালি বাড়িতে গোটা সেদ্ধ খাওয়ার রীতি বহু যুগ ধরে চলে আসছে। এই দিন বাংলায় রান্নাঘরে উনুন জ্বলে না। এই দিন শীল পাতার নিয়ম নেই, নোড়াকে বিশ্রাম দিতে হয়।

 

kichuri1

 

বাড়ির শীল ও নোড়াকে এদিন পুজো করা হয়। তাই আগের দিন রাতে রান্না করা হয় গোটা সেদ্ধ। যেহেতু শীতল ষষ্ঠী তাই পরের দিন ঠান্ডা খাওয়া হয় গোটা সেদ্ধ। সরস্বতী পুজোর সময় শীত বিদায় নিয়ে বসন্ত আসে। তাই আবহাওয়া পরিবর্তন জনিত কারণে এই সময় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। মনে করা হয়, এই গোটা সেদ্ধ জীবাণু সংক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করে। গোটা সেদ্ধ খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে।

ষষ্ঠী তিথি তাই ছয় রকমের সবজি দিয়ে এই পদ রান্না করা হয়। ছয় রকমের মরশুমি সবজি একসঙ্গে রেঁধে খাওয়াই হল গোটা সেদ্ধ। গোটা সেদ্ধ তৈরির নিয়ম অনুযায়ী, কোনও সবজি কাটা হয় না। আলুর খোসাও ছাড়ানো হয় না। গোটা অবস্থাতেই তা কড়াইয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তা সেদ্ধ হয়ে রান্না হয়ে যায়। তাই এই পদের নাম গোটা সিদ্ধ। গোটা সিদ্ধ রান্নার জন্য ছয়টি করে আলু, রাঙা আলু , বেগুন, শিষ পালং শাক, সিম, মটরশুঁটি নেওয়া হয়। তার সঙ্গে সবুজ মুগ কলাই, সরষের তেল, আদা বাটা, গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো, স্বাদ মতো নুন ও চিনি, পাঁচফোড়ন, গোটা জিরে, স্বাদ মতো শুকনো লঙ্কা দেওয়া হয়।

সরস্বতী পুজোর দিন বিকেলে সকল রমণীরা রান্না ঘর পরিষ্কার করেন। তারপর নতুন কড়াইয়ে গোটা সেদ্ধ বানানো হয়। প্রথমে কড়াই সরষের তেল দিতে হয়। এতে পাঁচফোড়ন ও শুকনো লঙ্কা দিতে হয়। এবার প্রথা মত সব সবজি না কেটে দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ডাল আর শাক দেওয়া হয়, তারপর একটু নেড়ে নুন হলুদ দিয়ে, পরিমাণ মতো জল দিয়ে কড়াই ঢাকা দিয়ে দিতে হবে।

 

ilish

 

কিছুক্ষণ পরে ঢাকা সরিয়ে একটু নেড়ে নিতে হবে, যাতে সেটা কড়াইতে লেগে না যায়। যখন সবজি ও ডাল সেদ্ধ হয়ে যাবে তখন লঙ্কা গুঁড়ো ও স্বাদ মতো চিনি দিয়ে। আরও কিছুক্ষণ রান্না হতে দিতে হবে। এতে সবজিগুলো আরও ভাল ভাবে মজে যাবে এবং জল শুকিয়ে মাখো মাখো হয়ে যাবে।

অন্য একটি কড়াইতে সর্ষের তেল গরম করুন তাতে পাঁচফোড়ন ও আটা বাটা দিয়ে ফোড়ন বানিয়ে, এই মিশ্রণটা গোটা সেদ্ধর ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দিলেই গোটা সেদ্ধ তৈরি। কর্মব্যস্ত বাঙালি আজ হয়ত গোটা সেদ্ধ খাওয়ার রীতি ভুলে গিয়েছে। তবে, এককালে প্রতিটি বাঙালির বাড়ির হেঁশেলে এই গোটা সেদ্ধ তৈরি হত। একে অন্যের বাড়িতে এই খাবার দেওয়ার রেওয়াজও ছিল।

সরস্বতী পুজোয় ঘটি বাড়িতে হয় গোটা সিদ্ধ। আর বাঙাল বাড়িতে আসে জোড়া ইলিশ, বাড়ির বড় ছেলে শুদ্ধ বস্ত্রে স্নান সেরে তা মাথায় নিয়ে বাড়ি ঢুকবেন। ঢোকবার আগে দাওয়ায় রেখে তেল-সিঁদুর লেপে প্রথমে পুজো হবে মৎস্যকুল শিরোমণির। মাছের রাজা তবে হেঁসেলে ঢুকবেন। ইলিশ আবার রাজা নন! মাছের রানি। বছরের প্রথম ইলিশ হল নতুন বউ। রান্নাঘরে নোড়ার সঙ্গে বিয়ে হবে তার। উত্তর কলকাতার কোনও কোনও বনেদি ঘটি-বাড়িতেও এই অভিনব বিয়ের পরম্পরা জারি রয়েছে। তবে সেটা ভরা বর্ষায়। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে। সাবেক ঘটি-বাড়িও কিন্তু পুজোর পরে ইলিশটা এড়িয়েই চলত।

সরস্বতী পুজোর জোড়া ইলিশের নেপথ্যে কিন্তু স্রেফ পূর্ববঙ্গের ঐতিহ্য। শিলনোড়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে যে ইলিশটি ঘরে তোলা হল, তা শুধু টলটলে কাঁচা ঝোল-অবতার হয়েই পাতে আসবে। লেখক বুদ্ধদেব বসু অবধি শ্রী পঞ্চমীর তরুণ ইলিশের নিরাভরণ ঝোলের প্রশস্তি গেয়ে গিয়েছেন। সরস্বতী পুজো মানেই বাঙাল বাড়ির গোটা বছরের ইলিশ ভোজের সূচনা। যা চলবে বিজয়া দশমী অবধি। এরপরে আর ইলিশ খাওয়া চলবে না। কিন্তু আজ ইলিশ মধ্যবিত্তের পকেটে টান ফেলেছে, তাই জোড়া ইলিশের বদলে জোড়া পুটি দিয়েই ঐতিহ্য রক্ষা হয়। কিন্তু হাল আমলের ব্যস্ত জীবন এইসব ঐতিহ্য রেওয়াজ পালনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...