তখনও শহর বহরমপুরের গোড়াপত্তন হয়নি। ইতিহাস বলছে, তার বহু আগে থেকেই বহরমপুর সংলগ্ন(তৎকালীন ব্রহ্মপুর) কালিকাপুরে ওলন্দাজ, কাশিমবাজারে ইংরেজ, সৈদাবাদে আর্মেনিয়াম এবং ফরাসডাঙ্গায় ফরাসিরা কুঠি স্থাপন করে প্রত্যেকেই ওই এলাকাগুলি থেকে আলাদাভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে আরো জানা যায়, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর স্থানীয় ইংরেজ শাসকরা ভাবল, মুর্শিদাবাদের নবাবকে আর বিশ্বাস করা যায়না। কাশিমবাজার ইংরেজদের কুঠিরও যথাযথ সুরক্ষার প্রয়োজন। তাই নিকটবর্তী বহরমপুর অঞ্চলে প্রয়োজন একটি সেনানিবাসের। কিন্তু সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন বিলেতের কর্তারা শাসনকার্যের তুলনায় ‘বাণিজ্যই প্রধান লক্ষ্য’-এই ভাবনায় ভাবিত হয়ে বহরমপুরে সেনানিবাস নির্মাণের কাজ তখনকার মত বন্ধ করে দেয়। কিন্তু পরবর্তীকালে মিরকাশিমের সঙ্গে বক্সারের যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাদের মনোভাব বদলায়। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বহরমপুর ব্যারাক স্কোয়ার সংলগ্ন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনা ব্যারাক ভবনগুলি নির্মাণের মধ্যে দিয়ে শহর বহরমপুরের গোড়াপত্তন হয়। এই বহরমপুর শহর ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বিতীয় পরিকল্পিত শহর। এরপর ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের পয়লা এপ্রিল বহরমপুর শহর সংলগ্ন বিভিন্ন অঞ্চলকে যুক্ত করে গঠিত হয় বহরমপুর পৌর এলাকা। আরও পরে ১৮৭৬ সালের পয়লা জুলাই বহরমপুর পৌরসভার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলে কাশিমবাজার, সৈদাবাদ, খাগড়া সহ স্বতন্ত্র বাণিজ্যিক জনপদগুলো ১৮৬৯ সালের পয়লা এপ্রিলের নির্ধারিত অঞ্চলগুলির সীমানা বিন্যাসের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বহরমপুর পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে ক্যান্টনমেন্ট শহর রূপে পথচলা শুরু হলেও ধীরে ধীরে শহরটি রূপান্তরিত হয় পৌরশহরে।
এই পৌর শহর বহরমপুরে প্রথমেই যে ঐতিহ্যবাহী ভবন স্থাপত্যটির কথা উল্লেখ করতে হয় তার নাম কাশিমবাজার বড়ো রাজবাড়ি বা শ্রীপুর প্যালেস। এই ঐতিহাসিক ভবনটি এবং এই পরিবারের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার ইতিহাসের এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা স্বনামধন্য ব্যবসায়ী শ্রী কৃষ্ণকান্ত নন্দী ও তার পুত্র লোকনাথ দ্বারা আনুমানিক ১৭৭২ থেকে ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে শ্রীপুর প্রাসাদটি নির্মিত হয়। রাজা কৃষ্ণনাথ, রানী স্বর্ণময়ী, মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর মত ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্বরা বাস করেছেন সেই বাড়িতে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিরূপে যোগদান করতে এই বাড়িতে এসেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উল্লেখ্য, সেই একবারের জন্যই মুর্শিদাবাদ জেলার মাটিতে পা রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়াও ১৯৯৪ সালে মৃনাল সেনের পরিচালনায় 'অন্তরীণ' ছবিটির শ্যুটিং হয়েছিল কাশিমবাজারের এই বৃহৎ রাজবাড়িতে। বর্তমানে বাড়ির সম্মুখভাগ রঙ করা হলেও অন্দরমহল ভেঙে গিয়েছে। ভেতরের অনেক মূল্যবান ঐতিহাসিক সামগ্রীর হদিস নেই।প্রাসাদের অন্দরে সাধারণ মানুষদের প্রবেশও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে রাজপরিবারের উত্তরসূরিরা। এই জেলার বহু বুদ্ধিজীবী শিক্ষানুরাগী মানুষজন শিল্প, শিক্ষা-সংস্কৃতির পীঠস্থান এই কাশিমবাজার বড়ো রাজবাড়ির প্রাসাদেই চেয়েছিলেন গড়ে উঠুক কৃষ্ণনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন। যাতে প্রাসাদ ভবনের কাঠামোটি এক ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন হিসেবে বেঁচে থাকবে বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। কিন্তু ইতিহাসের অনেক পালাবদল এবং ঊনবিংশ-বিংশ শতকের নবজাগরণের বহু সাক্ষ্য বহন করা জীর্ন-ভগ্নপ্রায় প্রাসাদটি আইনি জটিলতার মারপ্যাঁচে রোগশয্যায় শায়িত। সমস্যা সমাধানে ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় উদাসীন আমরা সকলেই। তবে কি আমাদের সকলের চোখের সামনে ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে বাংলার রেনেসাঁসের অন্যতম পীঠস্থানের এই স্মৃতিচিহ্নটি? এই আশংকা আর আতংক এখন ঘিরে রয়েছে সকলের মনে।
বহরমপুর শহরের উত্তরাঞ্চলে সৈদাবাদের প্রধান রাস্তার উপর প্রায় ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত সুবিশাল সৈদাবাদ রাজবাড়ী। কাশিমবাজারের শিক্ষানুরাগী দানশীলা মহারানী স্বর্ণময়ী উনিশ শতকের শেষ দিকে এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রধানতঃ গঙ্গাস্নান ও গঙ্গাতীরে বসবাসের জন্যই এই প্রাসাদ নির্মিত হয়। এই প্রাসাদেই মহারানী স্বর্ণময়ী ১৮৯৭ সালে তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটির পিছনের গঙ্গাতীরবর্তী অংশ সবটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। কয়েক দশক আগে এই প্রাসাদের সামনের দিকে দোতলায় নির্মিত কক্ষগুলিতে ছিল জেলা গ্রন্থাগার। বর্তমানে ওখানে কেবল অবস্থিত বহরমপুরের শহর লাইব্রেরি। ভবন কাঠামোকে সম্পূর্ণরূপে বজায় রেখে এই প্রাসাদের সংস্কারের জন্য মিলেছিল সরকারি প্রকল্পের অনুদান। কিন্তু অবৈধ দখলদার থাকার কারনে সে সম্ভাবনাও কার্যত দূরঅস্ত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সরকারি সম্পত্তিতে ক্রমেই বাড়ছে অবৈধ দখলদারের সংখ্যা।
বহরমপুর শহরের দক্ষিণপ্রান্তে গঙ্গা তীরবর্তী গোরাবাজার অঞ্চলে কৃষ্ণনাথ কলেজের একদা ছাত্রাবাস কুমার হোস্টেলের প্রায় ধ্বংসপ্রায় বাড়িটি একসময় ব্রিটিশরা সার্কিট হাউস হিসেবে ব্যবহার করত। ১৮৭০ থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ ছিল রাজশাহী ডিভিশনের অধীনে। যার সদর দফতর ছিল বহরমপুর। ব্রিটিশ ডিভিশনাল কমিশনার এখানেই বসবাস করছে। এই ভবনটির প্রধান অংশটি ১৮৩১ সালে নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়।
১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ক্যান্টমেন্টের প্রতিষ্ঠার হাত ধরে যে শহরের পথ চলা শুরু, সেখানে এমন আরও বহু ঐতিহ্য ছড়িয়ে আছে এখানে ওখানে।কোনটা সরকারি মালিকানা আবার কোনটা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তি। ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদে প্রশাসন থেকে সাধারণ ইতিহাস অনুরাগী মানুষ যদি সমবেতভাবে এগিয়ে আসে, তবেই হয়ত বাঁচতে পারে এইসব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য। আর সেই অতীত ঐতিহ্যের হাত ধরে বিকশিত হতে পারে পর্যটন শিল্প। ইতিহাস রক্ষার কোনো ইতিবাচক সাড়া মিলবে এমন আশায় এখনো বুক বেঁধে আছে বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদ জেলার অসংখ্য মানুষজন।