দার্জিলিঙয়ের বাইরে দার্জিলিঙ! তাই আবার হয় নাকি! পাহারের গায়ে কুয়াশায় ঢাকা শান্ত একটি শহর। যার বুকে চিরে এঁকে বেকে চলে যায় টয় ট্রেন। দুরে তাকালেই পাহারের ঢালে দেখা যায় চা বাগান। যত দূর চোখ যায় শুধু সবুজ। মাঝে মাঝে হাওয়ায় নড়তে থাকা বুদ্ধের পতাকা। খাদের ধারে কুয়াশায় ভেজা লোহার রেলিং। হিমালয়ের কোলে প্রকৃতির নিজের হাতে সাজানো শহর কি আর দ্বিতীয় একটা হয়! না সত্যিই হয়না। বাংলার সৌন্দর্য্য অপার, তারমধ্যে দার্জিলিং হলো তার মাথার মুকূট। বিভিন্ন সময়ে নানান রাজনৈতিক হামলায় কখনও কখনও তার বুকে হয়তো আঁচড় লেগেছে। কিন্তু ভোরের স্নিগ্ধ কুয়াশার মতো নিজেকে আবার মলিনতা থেকে তুলে ধরেছে দার্জিলিং। বৃহস্পতিবার সেই দার্জিলিং কেন্দ্রে চলছে নির্বাচন। না নির্বাচন নিয়ে নয় বরং দার্জিলিংয়ের প্রেমে পড়ে পাগল হয়ে যাওয়া এক ব্যক্তির গল্প শোনাব যে নিজের দেশের মাটিতে গড়ে তুলতে চেয়েছে আরেকটা দার্জিলিং।
হিমালয়ান রেলওয়ে সোসাইটির সভাপতি এবং লন্ডনের ভিভারেলের সিইও অদ্রিয়ান শুটার যিনি দার্জিলিঙয়ের ডিএইচআর ১৯ বি লোকোমটিভ ইঞ্জিন বা টয় ট্রেনটির মালিক। আজ পর্যন্ত একমাত্র এই টয়ট্রেনটির চাকা বিদেশের মাটিতে ঘুরেছে। ১৮৮৯ সালে গ্লাসগোতে তৈরি হওয়া এই টয়ট্রেনটি ১৯৬০ সাল পর্যন্ত দার্জিলিঙয়ে ছিল তারপর সেটিকে কিনে নেয় এলিয়ট ডনলে নামে একজন মার্কিনী। ডনলের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন সেটা আমেরিকার এক যাদুঘরে কাটায়। ১৯৯৯ সালে সেই যাদুঘরের একাংশ ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায়। তাতে ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই টয়ট্রেনটি। অপরদিকে ২০০০ সালে ভারতে ঘুরতে এসে দার্জিলিংয়ের প্রেমে পড়ে যান অদ্রিয়ান শুটার। সংবাদ পত্রে প্রকাশিত এক খবর পড়ে এই ১৯বি টয়ট্রেনটির কথা যানতে পারেন তিনি। ব্যস তৎক্ষনাৎ প্রাণের দার্জিলিঙয়ের একমাত্র লাইফলাইনকে কিনতে মার্কিন মুলুকে চলে যান তিনি। এবং ২০০২ সালে সেই টয়ট্রেনটিকে নতুন করে সারিয়ে তোলেন তিনি। তারপরেই ব্রিটেনের অক্সফোর্ডশায়ারে তাঁর বাড়ির বাগানে পাতা হয় লাইন। দার্জিলিঙয়ের মতো রেল ষ্টেশন সাজিয়ে তোলা হয়। সেখানে আছে ভারতীয় যেকোনও রেল ষ্টেশনে দেখতে পাওয়া অতি পরিচিত দৃশ্য, একটি চায়ের দোকান। রেল লাইনের পাশে উঁচু উঁচু মাটির ঢিবি তৈরি করে তাতে লাগানো হয়েছে বুদ্ধের পতাকা। গোর্খা টুপি মাথায় দেওয়া সাদা চামড়ার চা-ওয়ালা এসে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করে ‘সাবজি, চায়!’ পাশের রেলিংয়ে বাংলায় লেখা ‘বাঘ সংরক্ষণ করুন’ বা ‘সাবধান! বাদর আপনার খাবার কেড়ে নেবে’। তবে শুধু দার্জিলিঙ ষ্টেশনোর মতোই সাজানো নয়। সেখানে চড়তেও পারা যায় সেই টয় ট্রেনটি। শুটারের বাগানেই প্রায় ১ কিলোমিটার পথ ঘোরা যাবে সেই ট্রেনে চড়ে।
আমাদের দেশে টয়ট্রেন এসেছিল অবশ্যই ব্রিটিশের হাত ধরে। দীর্ঘ ১০০ বছরের বেশী পথ অতিক্রান্ত করে সে এখন হেরিটেজ রাইডের তকমা পেয়েছে। কিন্তু সংরক্ষণের সদিচ্ছা বা সঠিক সংরক্ষণের অভাবে সেই রাইড এখন ধুঁকছে। মাঝে মাঝেই বন্ধ করে দেওয়া হয় টয়ট্রেন। ফলে অনেক মানুষই হিমালয়ের বুক চিরে হেলেদুলে চলতে থাকা টয়ট্রেনে চড়ার মজা উপভোগ করতে পারেননা। সঠিক নজরদারি পেলেও এখনও ‘মেরি সপ্নো কি রানীর’ মতো সুন্দর দেখাবে তাঁকে। আর শুটার হয়তো সেই পথটাই আমাদের বাতলে দিচ্ছে। যদি সঠিক দেখভাল করা যায়, তাহলে ফের ঝুক ঝুক করে চলবে সাধের টয়ট্রেন।