কতদিন কোথাও বেড়াতে যাই না আমরা তাই না? সব মানুষেরই এখন অপেক্ষা কবে করোনা নামের এই বিচ্ছিরি অসুখটা পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে বা কবে এর প্রতিষেধক বেরোবে। আর তারপরেই আমরা হৈ হৈ করে বেড়াতে বেরিয়ে পড়বো। বাঙালির বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবলেই প্রথম কোন জায়গার কথা মনে পড়ে বলুন তো? ঠিক ধরেছেন... দার্জিলিং। আর দার্জিলিং বললেই.... কাঞ্চনজঙ্ঘা, টাইগার হিল আর.... আর টয়ট্রেন। চলুন আজ আপনাদের সঙ্গে এই ছোট্ট মিষ্টি পাহাড়ি ট্রেন নিয়ে আলোচনা করি যাকে আমরা ভালোবেসে টয়ট্রেন বলে থাকি।
ছোট্ট ছোট্ট দেশলাই বাক্সের মতো কামরা, কুউউউউউ ঝিকঝিক করে হুইসেল দিতে দিতে পাহাড়ি রাস্তার ধার দিয়ে, পাহাড়ি মানুষদের বাড়ির উঠোনের উপর দিয়ে, ঝর্নার ঝর ঝর শব্দ শুনতেল শুনতে কুয়াশার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের গায়ে পাকদণ্ডী বেয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে যেই ট্রেন। আমাদের, অর্থাৎ বাঙালির মনের মধ্যে কবে থেকে যে দার্জিলিং আর "টয় ট্রেন" সমার্থক হয়ে গেছে টেরও পাইনি। জানেন কি এই "টয়ট্রেন" নামটা কীভাবে এলো? এই নামটা দিয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন। ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি যখন দার্জিলিং গিয়েছিলেন তখন এই ট্রেনে চড়ে তিনি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সেই প্রথম তিনি এই পাহাড়ি ট্রেনের নাম দিলেন "টয় ট্রেন".. আর এই "টয় ট্রেন জার্নি"কে তাঁর জীবনের "একটি অন্যতম আনন্দের উপভোগ্য অধ্যায়" বলে অভিহিত করেছিলেন।
এই পাহাড়ি রেলপথ তৈরি হওয়ার একটা গল্প আছে। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই সমতলের সঙ্গে পাহাড়ের যোগাযোগের সুবন্দ্যোবস্তের জন্য ব্রিটিশরা পাহাড়ি রেলপথের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল। সেইমতো ভাবনা চিন্তা ও শুরু হয়েছিলো। কিন্তু কীভাবে ঐ পাহাড়ের গায়ে রেলপথ তৈরি করা যেতে পারে রেলের কর্তারা কিছুতেই ভেবে ঠিক করতে পারছিলেন না। এইরকম সময়ে এক শীতের সন্ধ্যায় শিলিগুড়ির কাছে তিনধারিয়ায় "টি প্ল্যান্টার্স ক্লাবে" একটা পার্টি হচ্ছিল। সেই পার্টিতে যোগ দিতে এসেছেন ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে’-এর এজেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন প্রেস্টিজ। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। সেখানে ফায়ার প্লেসকে ঘিরে সবাই নাচে মেতে উঠলেন। কিন্তু প্রেস্টিজ সাহেবের নাচে মন নেই। তিনি ভেবে চলেছেন, কী ভাবে দার্জিলিং পাহাড়ে রেলপথ বসানো যায়। স্ত্রীর সঙ্গে নাচে পা মিলাতে পারছিলেন না। সকলের সামনে লজ্জায় পড়ে গেলেন শ্রীমতী প্রেস্টিজ। স্বামীকে ফিসফিস করে বললেন, ‘‘খোলা মনে যদি এগিয়ে আসতে না পার, তবে এখান থেকে ফিরে যাচ্ছ না কেন?’’ ব্যস! প্রেস্টিজ সাহেব পেয়ে গেলেন তাঁর সমস্যার সমাধান..... খাড়া পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠার উপযোগী আগু-পিছু করে চলার বিশেষ ধরনের পদ্ধতি ‘জেড রিভার্সিং’, কঠিন চড়াইকে সহজ করতে ইংরেজি জেড অক্ষরের মতো রেললাইন পাতার জিগজ্যাগ পদ্ধতি। তৈরি হলো "দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে"..
শিলিগুড়ি থেকে প্রথমে দু’ফুট গেজের লাইন পাতার কাজ শুরু হল। সুকনা, রংটং হয়ে তিনধারিয়া পর্যন্ত লাইন বসিয়ে ১৮৮০ সালের মার্চে ভাইসরয় লর্ড লিটনকে নিয়ে প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে যাত্রা শুরু করে টয়ট্রেন। সে বছরই খুলে যায় শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং অবধি রেলপথ। প্রথমবার ট্রেন দার্জিলিং পৌঁছয় ১৮৮১ সালের ৪ জুলাই। ঠিক তার পরের বছর, ১৮৮২তে টয়ট্রেনে চড়ে দার্জিলিং যান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সাধারণত, পাহাড়ি পথে চড়াই-উতরাই কমানোর জন্য সুড়ঙ্গ গড়া হয়। দার্জিলিং পাহাড়ে কিন্তু একটিও সুড়ঙ্গ নেই। লুপ আর জেড রিভার্সিং ব্যবহার করে সরীসৃপের মতো উঠেছে এই রেলপথ। এ পথে প্রথম দিকে পাঁচটি লুপ ছিল। বিখ্যাত ‘বাতাসিয়া লুপ’ তখন ছিল না। ট্রেনের চড়াইকে সহজ করতে ১৯১৯ সালে তা তৈরি হয়।
তবে প্রকৃতির রোষানল থেকে রেহাই পায়নি এই রেলপথ। বর্ষাকালে ধস নেমে বারবারপ ভেঙে গেছে রেললাইন। বর্তমানে পাহাড়ে নিয়মিত ধসের কারণে টয় ট্রেন এখন অনেকটাই অনিয়মিত। তা সত্ত্বেও মোটামুটি ভাবে দার্জিলিং স্টেশন থেকে পৃথিবীর অন্যতম উঁচু স্টেশন ঘুম পর্যন্ত জয়রাইড হয় এখনও।
জয় রাইডে থাকে ইঞ্জিনের পিছনে নীল রঙের তিনটি প্রথম শ্রেণির চেয়ারকার। ভিতরে দুই সারিতে সাজানো দু’টি করে বসার গদি আঁটা চেয়ার । সেগুলো গাড়ির অভিমুখে দিব্যি ঘুরিয়ে নেওয়া যায়। পায়ের নীচে থাকে কার্পেট। বড় বড় কাচের জানালায় সুন্দর পর্দা ঝোলানো। বেশ তর্জন, গর্জন করে দার্জিলিং স্টেশন থেকে ছাড়ে গাড়ি। পথচলতি মানুষ, স্কুলে যাওয়া বাচ্চারা হাসতে হাসতে হাত নাড়ে । ব্যাপারটা ভারি মজার! "ঝমর ঝম ঝমর ঝম চললো গাড়ি রেলের গাড়ি".... এ গাড়ি যত না এগোয় তার চেয়ে বেশি আওয়াজ করে। বাতাসিয়া লুপে এসে থামে মিনিট দশেক। তার পরে আবার চলা শুরু করে দুলকি চালে এসে থামে একেবারে ঘুম স্টেশনে। এই রেলপথে তো বটেই, এক সময় এটি ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্টেশন। মেঘ কুয়াশা জড়ানো থমথমে নির্জন স্টেশন ঘুম যেন ঘুমিয়েই আছে। এখানে গাড়ি মিনিট চল্লিশেক দাঁড়ায়। স্টেশনের পাশেই আছে এক সংগ্রহশালা। ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত রেলগাড়ির যাবতীয় সরঞ্জাম প্রদর্শিত হয়েছে। সঙ্গে পুরনো আমলের টয় ট্রেনের দুষ্প্রাপ্য সব ছবি এবং সে যুগের খেলনা রেলের মডেল সাজানো। দেখতে দেখতেই কেটে যায় সময়। বেজে ওঠে ফেরার বাঁশি।
এই টয়ট্রেন বা দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েকে তার ঐতিহ্যের কারণেই ইউনেস্কো ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে "World Heritage" ঘোষণা করেছে। টয়ট্রেন আমাদের অহঙ্কার। একে রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদেরই।