জেনে নিন কলকাতার কোথায় পাবেন স্বাদে সেরা ‘হালিম’

রোজা-রমজান-ইফতার আসতেই কলকাতা দখল নিয়ে নিয়েছে ‘হালিম’। কাবাব-বিরিয়ানির সারা বছরের হ্যাংলামি মুলতুবি কিছুদিন। হোটেল রেঁস্তোরার সামনে বিরিয়ানির হাঁড়ি হঠাৎ বদলে গিয়েছে হালিমের হাঁড়িতে। পিতলের হাঁড়িতে টগবগিয়ে ফুটছে হালিম। কাস্টমার চাইলেই লম্বা লোহার হাতায় করে তুলে কাচের বাটিতে। পরিবেশনের সময় ওপরে ছড়িয়ে দেয় বেরেস্তা, সবুজ ধনেপাতা, আদা, কাঁচা লঙ্কা ও লেবু। আর একহাতা ঘিয়ের মতো গলানো চর্বি। বেজায় স্বাদ হয়ে তাতে!

যেমন দামে চাইবেন ঠিক তেমন দামে পাবেন। স্বাদ আর মানের তফাৎ-ও আছে বৈকি!

হালিম কী?

সাদা বাংলায় এই খাদ্যটিকে ডাল, মাংস আর মশলা অনবদ্য খিচুড়ি হিসেবে মনে করা হলেও আসল হামিলের স্বাদ যিনি পেয়েছেন তিনি জানেন বিষয়টি মোটেই তা নয়।

হালিম শব্দের আক্ষরিক অর্থ সহিষ্ণু। আল্লার নিরানব্বইটি নামের মধ্যে এক নাম।

হালিমের মূল উপাদান বিভিন্ন রকমের ডাল, গম,  সুগন্ধি চাল এবং মাংস। মুগ, মুসুর, অঢ়হড়, ছোলা আট ঠেকে দশ রকমের ডাল। ৬-৮ ঘন্টা জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর সেই ডাল, চাল ও গম ভালোভাবে সেদ্ধ করে নিতে হয়। পরিমাণমত পেঁয়াজ বাটা, রসুন বাটা, আদা বাটা, এলাচ, মরিচ গুড়ো, হলুদ গুড়ো, দারুচিনি ও গরম মশলা সমেত আলাদা পাত্রে মাংস ভালোভাবে কষিয়ে নিতে হয়। তারপর ভালোভাবে মিহি করে নেওয়া সেদ্ধ ডাল, চাল ও গম কষানো মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে, পরিমাণমত জল ও নুন দিয়ে আরও ঘন্টাখানেক নাড়তে হয়। এভাবেই তৈরি হয় হালিম। প্রায় ১০ ঘন্টার কাছাকাছি সময় লাগে হালিম রাঁধতে।

রন্ধন ইতিহাসবিদ ক্লডিয়া রডেনের মতে মধ্য-প্রাচ্যের মানুষরা, ডাল মাংস মশলা দিয়ে খিচুড়ির মত এক ধরনের পদ বানাতেন। যার ডাকনাম ছিল ‘হারিশা’। ‘হরিশা’ই নাম বদলে আজকের ‘হালিম’।

‘হারিশা’ ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়ামেন ও আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে পছন্দের পদ।তবে লেভান্ত অঞ্চলে অর্থাৎ বর্তমান সিরিয়া ও লেবাননে বহুযুগ আগে থেকে খ্রিস্টানরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হারিশা বিশেষভাবে রান্না করতেন। অনেকটা বাংলাদেশে লাইলাতুল বরাতে হালুয়া রুটি তৈরির মতো।

লন্ডনপ্রবাসী প্রখ্যাত রন্ধন বিশেষজ্ঞ আনিসা হেলউতার Lebanese Cuisine(1994) গ্রন্থে লিখেছেন, লেভান্তে গরিবদের একসঙ্গে খাওয়ানোর জন্য বড় ডেকচিতে হারিশা রান্না করা হত, যার তুলনা করা যেতে পারে বর্ষার দিনে বাঙালি’র প্রিয় কিমা খিচুড়ির সঙ্গে।

হারিশার সবচেয়ে পুরনো লিখিত রেসিপি পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় দশম শতকের দিকে বাগদাদে কিতাব আল তাবিখ (The book of recipes) নামের রান্নার বইতে। এই বইটিতে সংকলন করা হয়েছিল তৎকালীন রাজা বাদশাহদের খাবার টেবিলের উপাদেয় বেশ কিছু খাবারের রন্ধনপ্রণালী। বইটির লেখক আবু মুহাম্মদ আল মুজ্জাফর ইবন সায়ার। এমনকি ইবন বতুতার ভ্রমণ কাহিনীতেও তিনি উল্লেখ্য করেছেন পারস্যে ডাল, ঘি এবং গোশত দিয়ে রান্না করা হারিশার কথা।

‘হারিশা’র ভারতীয় নাম ‘হালিম’ কেন হল?

এই প্রশ্নের নানা রকম উত্তর পাওয়া যায়। তবে সব চেয়ে লজিক্যাল কারণটা বোধহয়, হালিম স্লো কুক ডিশ। হালিম রান্না করতে প্রচুর সময় ও ধৈর্যের দরকার। আরবিতে হালিম শব্দের অর্থ হলো ধৈর্যশীল। হয়ত সেখান থেকেই নামকরণ করা হয়েছে হারিশার ভারতীয় সংস্করণ হালিমের।

কীভাবে ভারতে এল ‘হালিম’?

ভারতে হারিশা’র আগমন মুঘলদের মাধ্যমে। দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের আমলে হারিশা ভারতে এলেও জনপ্রিয়তা পায় হুমায়ূনের পুত্র সম্রাট জালাউদ্দিন আকবরের আমলে। সম্রাট হুমায়ুনের সঙ্গে পারস্যের সাফাভি সাম্রাজ্যের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তাই বলা যায় পারস্য হয়ে হারিশা ভারতে এসেছিল।

আকবরের শাসন আমলে লিখিত আইন-এ-আকবরী গ্রন্থে পাওয়া যায় হারিশার কথা। তবে ভারতবর্ষে আরব বণিক ও ইসলাম প্রচারকদের আগমন সেই রাসুলুল্লাহ হজরত মুহম্মদ (সাঃ) এর সময় থেকেই। তাই আরবদের হাত ধরে যে ভারতে হারিশা এসেছিল, এ নিয়ে কোনও দ্বিধার অবকাশ নেই।

হায়দ্রাবাদী হালিম

বিরিয়ানীর মতোই হায়দ্রাবাদী হালিমও হায়দরের শহরের সিগনেচার। ভারতবর্ষে হালিম জনপ্রিয়করণের পেছনে হায়দ্রাবাদী হালিমের অবদান অনস্বীকার্য। হায়দ্রাবাদের নিজামদের আরব সৈন্যরাই নাকি হারিশা এনেছিল হায়দ্রাবাদে। তবে বিংশ শতকে হালিমকে জনপ্রিয় করেছেন যে মানুষটি তিনি সুলতান সাইফ নাওয়াজ জং বাহাদুর।

ইয়েমেনী জমিদার সুলতান সাইফ ছিলেন হায়দ্রাবাদের নিজামদের দরবারের খানদানি আমির ওমরাহ্‌দের একজন। তাঁর বাড়িতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত মেহমানদের দাওয়াতে সব সময় থাকত মাতৃভূমি ইয়েমেনি ছোঁয়া। হারিশা। ইয়ামেনি হারিশা ভারতীয় মশলার আদরে আজকের হালিম।

881710-hkaczpctar-1528384996

মধ্যপ্রাচ্যের হারিশার সঙ্গে ভারতবর্ষের হালিমের মূল পার্থক্যটাই হল মশলার ব্যবহারে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য খাবারগুলোর মতোই হারিশাতে মশলা ব্যবহার করা হয় তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু ভারতবর্ষে মশলার সমারোহ এবং জনপ্রিয়তার কারণে হালিমও হয় বেশ মশলাদার।

নিজামদের যুগ অবসান হওয়ার পর ১৯৫০ এর দশকে হায়দ্রাবাদের ইরানি খাবার হোটেলগুলোতে সর্বপ্রথম হালিম বিক্রি শুরু হয়।তখন এক বাটি হালিমের দাম ছিল মাত্র ৩ পয়সা।

হালিমের ব্যাপক জনপ্রিয়তার জন্য ২০১০ সালে ইন্ডিয়ান পেটেন্ট অফিস হায়দ্রাবাদী হালিমকে প্রথম ‘ননভেজ খাবার’ হিসাবে পেটেন্ট দিয়েছে। মানে, ভারতে কেউ হায়দ্রাবাদী হালিম নামে কোনো হালিম বিক্রি করতে চাইলে তাকে নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড মেনে হালিম বানাতে হবে।

কলকাতার হালিম জয়েন্ট

কলকাতা শহরে বেশ কয়েকটা হালিম জয়েন্ট রয়েছে।

‘হালিম ট্রেন্ড’ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই সেই সব জায়গায় হালিমের হাঁড়ি দেখা যায়। সারা বছর ভিড় লেগে থাকে। সেই অর্থে ঝকঝকে-চকচকে গ্ল্যমার নেই। কিন্তু খাবারের গন্ধ আপনাকে টেনে আনবে।

কলকাতা কর্পোরেশন বিল্ডিংয়ের কাছে, এক সময় যেখানে এলিট সিনেমা ছিল তার ঠিক উল্টো দিকে ডান হাতের রাস্তায় ‘আমিনিয়া’।  সোজা হগমার্কেটে দিকে এগোলে বরদা ব্যাঙ্কের এটিএম। তার সামনেই পাবেন এই অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় ‘হালিমওয়ালা’কে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে খাবার অভ্যাস থাকলে চেখে দেখতেই পারেন।

ওয়াটার লু স্ট্রিটের আলিয়া৷ ৭৫ বছরের পুরনো। মাটন হালিমের জন্য বিখ্যাত ৷

সেন্ট্রাল মেট্রো থেকে মিনিট দশেক হাঁটলেই নাখোদা মসজিদের গলি। কলুটোলাকে ল্যান্ডমার্ক ধরে এগোলে পেয়ে যাবেন জাদিদ ইসলামিয়া হোটেল। ৮৫ বছরের পুরনো। এখানে স্পেশাল আরবি হালিম পাবেন। রয়্যাল ইন্ডিয়া হোটেল। চিকেন, মাটন দুই ধরনের হালিম-ই পাওয়া যায়।

গোটা জাকারিয়া স্ট্রিট,  ফিয়ার্স লেন জুড়েই অনেক হালিমের দোকান পাবেন। প্রেসিডেন্সির পিছন দিক ধরে হাঁটলে কলাবাগান। চাঁদনি চক, রাজাবাজার বাদ দেবেন না। হালিমের জন্য ট্রাই করতে পারেন।

মিস করবেন না পার্কসার্কাস। জিশান, সিরাজ, আরসালান তো আছেই এছাড়াও হাঁটতে পারেন মল্লিকবাজার, বেকবাগানের ফুটপাত ধরেও। খালি হাতে ফিরবেন না। খিদিরপুরের ইন্ডিয়া রেস্টুরেন্ট। বিরিয়ানির জন্য জনপ্রিয় কিন্তু হালিমের জন্যও মনে রাখতে পারেন।

খাবারের ইতিহাস ভূগোলের ঠেকে অনেক বেশি সুস্বাদু তার জিভে চেখে দেখা স্বাদ। খিদের যেমন ধর্ম হয় না তেমন বোধহয় স্বাদেরও। সব ধর্ম মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় ভাল স্বাদের কাছে।লেটেস্ট হালিম ট্রেন্ড সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...