আনন্দ গান্ধী পরিচালিত ছবি ‘শিপ অব থিসিয়াস’-এর অন্ধ মেয়েটির কথা মনে পড়ে যায়, যে দৃষ্টিশক্তি ছাড়াই হয়ে ওঠে উঠেছিল একজন আলোকচিত্রী শিল্পী। অন্ধত্বকে স্বীকার করে নয়, সাধারণের মতোই সে ‘বিশেষ’ পরিচিতি তৈরী করে নিয়েছিল তার স্বাভাবিক প্রতিভার বিকাশে। ‘শিপ অব থিসিয়াস’-এর এই প্রসঙ্গ উত্থাপনের নেপথ্যে যিনি, তিনি হলেন ব্রিটিশ নাগরিক টনি জাইলস। ৪১ বছর বয়সী এই মানুষটি দৃষ্টিহীন এবং বধির। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা স্বত্ত্বেও ভ্রমণের নেশায় ইতিমধ্যেই ১৩০টির বেশি দেশ ঘুরে বেড়িয়ে নজির তৈরী করেছেন তিনি। বিশ্বের সবকটি মহাদেশ ঘুরে এখন তার লক্ষ্য বিশ্বভ্রমণ করার।
তাঁর কথায়, আমি মানুষের কথা শুনি, পাহাড়ে উঠি, সবকিছু আমি আমার স্পর্শ এবং পায়ের মাধ্যমে অনুভব করি। ওভাবেই আমি একটি দেশ দেখি।
টনি গত ২০ বছর ধরে নতুন নতুন জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছেন। একাই। এই সফরই তাঁকে খুঁজে দিয়েছে মনের মানুষ। একটি সফরে তিনি পরিচিত হন তাঁর গ্রিক বান্ধবীর সঙ্গে যিনি নিজেও অন্ধ।
অধিকাংশ ভ্রমণে টনি একাই ঘুরে বেড়িয়েছেন। টনির এই ভ্রমণের অর্থ জোগাড় হয় তাঁর বাবার পেনশনের টাকা থেকে। ফলত আগে থেকেই যথেষ্ট পরিকল্পনা করে ভ্রমণসূচি ঠিক করেন তিনি। প্লেনের টিকিট কাটার ক্ষেত্রে তাঁর মা তাঁকে সাহায্য করেন, কারণ টনির মতে, অধিকাংশ এয়ারলাইন্স কোম্পানিতেই অন্ধদের জন্য যথেষ্ট সুবিধা নেই।
কোনো দেশে থাকার সময় যাঁরা তাঁকে সাহায্য করেন, তাঁদের সাথে আগেই বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ করে নেন তিনি।
টনির যখন নয় মাস বয়স, তখনই তাঁর চোখের সমস্যা প্রথম ধরা পড়ে। দশ বছর বয়সে তার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। ছয় বছর বয়সে তিনি আংশিক বধির হয়ে যান। বর্তমানে কানে শোনার জন্য শক্তিশালী ডিজিটাল হিয়ারিং এইড ব্যবহার করলেও সব ধরণের শব্দ শুনতে পারেন না তিনি।
একটি বিশেষ স্কুলে পড়ালেখা করেন এবং সেই স্কুল থেকেই ১৬ বছর বয়সে প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণ করেন। এখনো মাঝেমধ্যে নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন টনি। ২০০৮'এ কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে তার কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হয়। ১৫ বছর বয়সে বাবাকে হারান টনি। ১৬ বছর বয়সে হারান তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে, যিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন।
২০০০ সালের মার্চে নিউ অরলিন্সে ভ্রমণের মাধ্যমে তার ব্যাকপ্যাকিং অ্যাডভেঞ্চার শুরু হয়। টনি বলেন, আমার এহেন ঘুরে বেড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল নিজের আবেগ থেকে পালানো। নতুন নতুন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর ফলে আমার মধ্যে অনেক ইতিবাচক চিন্তাও তৈরি হয়েছে। মানুষের সাথে মেশার পর আমি বুঝতে পারি, আমি অন্ধ বলে তারা আমার সাথে মেশে না - মেশে আমার ব্যক্তিত্বের জন্য।
টনি খুবই কম খরচের মধ্যে ঘোরাঘুরি সারেন। যে কোনও জায়গায় তিনি গ্রুপ ট্র্যাভেল করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। থাকার ক্ষেত্রেও একদমই সাদামাটা জায়গা পছন্দ করেন তিনি।
সবকিছু স্পর্শের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করেন টনি। অনুভবের মাধ্যমে পরিচয় পেতে চান বিভিন্ন বস্তুর। মানুষের সাথে কথা বলে এবং অন্যদের কথা শুনে নিজের মনে সবকিছুর একটি চিত্র তৈরি করেন তিনি। সব অঞ্চলের স্থানীয় খাবার খাওয়াও তার ভ্রমণের অন্যতম লক্ষ্য। টনি অনেক দর্শনীয় জায়গায় গিয়েছেন, বিভিন্ন জায়গা নিয়ে লেখা এবং ছবি তোলাও তাঁর নেশা। তাঁর নিজের একটি ব্লগও রয়েছে।
যে কোনো জায়গায় সাধারণত দুর্গম পথ এড়িয়ে চলেন টনি। অধিকাংশ সময়ই নিজের জন্য আলাদাভাবে গাইড ভাড়া করেন তিনি। তবে মাঝেমধ্যেই গাইড পান না সাথে, এবং কখনো কখনো পথও হারিয়ে ফেলেন। তবে হারিয়ে গেলেও আতঙ্কিত হন না টনি। অপেক্ষা করেন কোনো একজন পথিকের জন্য, যে তাঁকে সাহায্য করতে পারে।
বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানোর সময় সেসব অঞ্চলের বিভিন্ন ধরণের ফোক বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পছন্দ করেন টনি। তিনি বলেন, সঙ্গীত আমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়গুলোর একটি। সঙ্গীতের মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। সঙ্গীত সব বাধা অতিক্রম করতে পারে।