১৮ বছর বয়স। দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। তবে সঙ্গতির ভাঁড়ার শূন্য। সেই শূন্য থেকেই শুরু করেছিলেন তিনি। পৌঁছেছিলেন অযুত-লক্ষ-নিযুত-কোটিতে। হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পপতি। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের সড়ক-রাজপথে জ্বলজ্বল করে তাঁর স্বপ্নের চিহ্ন-বাটা। মানুষটির নাম টমাস বাটা।
শুধুমাত্র সেরা শিল্পপতি নয় জেমস বাটা এক অনুপ্রেরণার নাম। ব্র্যান্ড বাটা যতটা জনপ্রিয় ততটা আড়ালে থেকে গিয়েছে টমাস বাটা’র জীবন।
আত্মজীবনী লিখেছিলেন টমাস বাটা। কিন্তু শেষ করতে পারেননি, লেখার কাজ, তার আগেই তাঁর সময় ফুরোয় এ গ্রহে। আত্মজীবনীর নাম দেন ‘How I began’।
সেই বই ঘটনাচক্রে এসে পড়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। মুগ্ধ কথাশিল্পী নিজেই শুরু করে দেন বই বাংলায় অনুবাদের কাজ। মনে হয়েছিল বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি তরুণ-তরুণীর জানার দরকার আছে এই কাহিনি। অনুবাদের কাজ শেষ হতে পান্ডুলিপি নিয়ে তিনি গেলেন আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছে। আচার্য্য বেঙ্গল কেমিক্যাল শুরু করেছেন, বাঙালি তরুণ-তরুণীদের উৎসাহ দিচ্ছেন ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে ওঠার। বিভূতিভূষণকে বিমুখ করলেন না তিনি। প্রকাশিত হল বাংলা ভাষায় টমাস বাটার আত্মজীবনী। অনুবাদক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছিলেন আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র স্বয়ং।
টমাসের জন্ম চেকোস্লোভাকিয়াতে। তাঁর মা ছিলেন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক। ছেলেকে বাইবেলের পদ আবৃত্তি করে শোনাতেন। ছেলেও মুখে মুখে শিখে নিত বেশ। বছর ছয়েক যখন বয়স তখন থেকেই বাতিল চামড়া জুড়ে জুড়ে জুতো তৈরি করতেন। তবে সেসব জুতোর সাইজ একেবারে বুড়ো আঙ্গুলের মাপে। আকারে খুদে হলে কী হবে দেখতে একেবারে আসল জুতোর মতো। একেবারে নিখুঁত। এক জোড়া জুতো বানাতে সারাদিন লেগে যেত।
খেলার ছলে তৈরি জুতো কিন্তু কিনে নিয়ে যেত মানুষ। এক একটার দাম দশ ব্রিউজার। পেনির হিসেবে সে মূল্য খুব একটা খারাপ নয়! টমাসের বাবা-ঠাকুরদা সবাই পেশায় দক্ষ চর্মকার। বাবার কাছেই একটু একটু করে শিখে ১০ বছর বয়সে মাকে হারাতে হল।
ওই বয়স থেকেই টমাস জুতো তৈরিতে দিন দিন দক্ষ হয়ে উঠতে লাগলেন। বালক বয়স থেকেই জড়িয়ে গিয়েছিলেন বাবার ব্যবসার সঙ্গে। ১২ বছর যখন বয়স তখন পরিষ্কার বুঝতে পারছিলেন তাদের পেট ভরা খাবার আর ভাল থাকার এক মাত্র উপায় বাবার ব্যবসা। দু’বছর পর বাবার ব্যবসায় বিক্রির কাজটা টমাসের দায়িত্বে এসে পড়ল। কিশোর টমাস কিন্তু এক ফোঁটা ভয় পাননি।
বাসা বদল, বাবার ব্যবসা, নতুন ফলের ব্যবসায় দেখাশোনার কারণে বারবার বাধা আসায় এক সময় ছেড়ে দিলেন স্কুলের পাঠ। ধরাবাঁধা পড়াশোন থেকে মুক্তি তো মিলল কিন্তু তাতে খুব খুশি হতে পারেননি টমাস। বাড়িতে বইপত্তরের পাঠ তো নেই, বই বলতে শুধু পঞ্জিকা। তবু এক বই-ই বদলে দিয়েছিল তাঁর জীবন। সে বইয়ের নাম সচিত্র চেক জাতির ইতিহাস।
টমাসের মাথায় ক্রমশ চেপে বসছিল নিজের কিছু করার তাগিদ। ভিতর ভিতর অনুভব করতে পারছিলেন, বাবার ব্যবসায় নিজের ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। নিজের ভিতর খিদে ক্রমশ বাড়ছিল।
মায়ের মৃত্যুর সময় টমাসকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই অর্থ চাইলেন বাবার কাছে। কিন্তু তা খরচ হয়ে গিয়েছে ততদিনে। শেষ পর্যন্ত কপর্দকশূন্য অবস্থাতেই ভিয়েনা পাড়ি দিলেন টমাস। নিজের অল্প জমানো টাকা আর বোন আনার সামান্য অর্থ সাহায্যে এক আত্মীয়ের বাড়ির ছোট্ট এক চিলতে জায়গায় শুরু করলেন নিজের জুতোর ব্যবসা।
প্রথম প্রথম মিকাডো নামে এক ধরনের জুতো তৈরী করে বিক্রি করতেন। পুঁজির সবটা মাল তৈরীতে লাগিয়ে দিলেন। এদিকে বিক্রি নেই। তারওপর লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসার কারণে পুলিশি সমস্যায় পড়তে হয়। অগত্যা ফের বাবার ব্যবসায় ফিরে যাওয়া।
বাবার ব্যবসায় কয়েক বছর ভালোভাবে হাত পাকানোর পর ১৮৯৪তে ফের টমাস মন দিলেন নিজের ব্যবসা শুরুর কাজে। এবার সঙ্গে পেলেন দাদা আন্তোনিন আর বোন আনাকে। এবার আর ভুল করলেন না। লাইসেন্স থেকে কর্মচারী সব নিয়ে শুরু হল নতুন জুতোর ব্যবসা। অস্ট্রো-হাঙ্গেরি জলিন শহরে তৈরি হল একটা ছোট্ট কারখানা। নাম ‘টি অ্যান্ড এ বাটা’।
জীবনের এখান থেকেই আসল কাহিনি শুরু হয় টমাসের। নানা বিপর্যয়, সংকট আর টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পৌঁছতে লাগলেন বৃহত্তর ক্ষেত্রে। তবে ঘুরে দাঁড়াতে গেলে সবসময় একটা টার্নিং পয়েন্টের প্রয়োজন হয়। টমাস বাটার টার্নিং পয়েন্ট ‘ক্যানভাস শ্যু’।
টমাসের জুতো কারখানায় একদিন তৈরী হল কাপড় দিয়ে ক্যানভাস শ্যু। পৃথিবীর প্রথম কেডস জুতো। চামড়া নয়, এই জুতো তৈরী হল কাপড় দিয়ে। ধনী দরিদ্র সকলেই কিনতে পারবে ক্যানভাস শ্যু।
টমাস সাহেব আরও ভাল করে প্রোডাকশন বুঝতে চলে আসেন আমেরিকায়। যন্ত্রপাতি, উৎপাদন আর সমস্যার সহজ সমাধান এই তিনটি জিনিস শেখার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি নিজিস শিখলেন- নিজের কারখানার কর্মীদের সঙ্গে ব্যবহারের সহবত, শ্রদ্ধা আর সম্মান। বুঝেছিলেন সাফল্য আসে টিমওয়ার্ক থেকেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মিলিটারিদের জুতো তৈরীর বরাত পেয়েছিলেন সেই থেকেই সাফল্যের শিখরে ওঠে টমাস সাহেবের সংস্থা।
১৯২৫ থেকে ভারতে শুরু হয় বাটার জুতোর আমদানি। চেকোশ্লোভাকিয়া থাকা আসা জুতোর দামও সময়ের হিসেব অনুযায়ী ছিল অনেকটাই। গড়ে ৭ থেকে ১০ টাকা। এমন সময়ের কথা যখন মানুষ ১০ টাকা মাস মাইনেতে নতুন সংসার পাতার সাহস পেত। ১৯৩৩-এ ভারতে প্রথম বাটার কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। হুগলির কোন্ননগরে। টমাস সাহেবের পুত্রের দ্বারা। কারণ তার ঠিক এক বছর আগেই সুইজারল্যান্ডে সংস্থার শাখা উদ্বোধন করতে গিয়ে বিমান দুর্ঘটনায় প্রয়াত হন টমাস সাহেব।
টমাস সাহেবের জীবদ্দশাতেই একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসত। তাঁর গড়া বিশাল বাটা সাম্রাজের উত্তরাধিকার কে?
সে প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছিলেন নিজেই। বাটার সমাধিফলকে লেখা, ‘এই ব্যক্তি তাঁর কাজকর্ম এমনভাবে সুব্যবস্থার সঙ্গে সম্পন্ন করতেন যে যে কোন সময় সব চুকিয়ে চলে যেতে পারতেন।’
কথাগুলো কতটা সত্যি তার প্রমাণ আজকের বাটা। আজও বাঙালি পুজো এলে নতুন জুতো কেনার সময় বলে সেই লাইন- ‘পুজোয় চাই নতুন জুতো’। খবরের কাগজের পাতা থেকে বেরিয়ে আসে টুকটুকে লাল ক্যানভাস জুতো পায়ে দেওয়া বাঙালির শিশুকাল। প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা চলে বাটার মোড়ে। বাস আসে, যাবে অন্য কোথাও সেখানেও পেয়ে যাবে কোন ‘বাটা স্টপেজ’...