নজরুল মঞ্চে কনসার্ট । গুলাম আলি খাঁ আর জগজিৎ সিং।
শহরের ওম্ পেতে অনুষ্ঠানের একদিন আগেই পৌঁছবেন জানালেন জগজিৎ।পা-ও পড়ল কথা মতন।
ফোনের একদিকে কলকাতার আয়োজকরা। অন্য প্রান্তে চেনা ব্যারিটোনে তিনি।
গলায় চাপা কান্নার খসখসে শব্দ।মা চলে গিয়েছেন। সেদিন সকালে।
তবে অনুষ্ঠান?
সবাইকে অবাক করে নির্ধারিত সময়েই শহরে পৌঁছলেন তিনি ।
মা-কে দাহ করে সোজা ছুটে এসেছেন।
ব্যক্তিগত ক্ষয়-ক্ষতি ছাপ ফেলতে পারেনি অনুষ্ঠানের নির্ঘ্নটে।
বুকফাটা হাহাকার আছড়ে পড়েছিল সুরের মূর্ছনায়। বানভাসী হয়েছিল শ্রোতারা।
আঠারোর তরতাজা পুত্রকে হারিয়েছিলেন দুর্ঘটনায়। সেই যন্ত্রণার পারদেও সুর নেমেছিল কান্না ডিঙিয়ে। ভিজেছিল আসমুদ্রহিমাচল।
গজল ঘরানার চেনা ছাঁচ নতুন রঙে সেজে উঠেছিল তাঁর কণ্ঠের ক্যানভাসে ।
সেই জাদুকর আর অন্য কেউ নন। জগজিৎ সিং। গজল সম্রাট।
১৯৪১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। পঞ্জাবের শ্রীগঙ্গানগর। এক সঙ্গীত পরিবারে জন্ম ।
ছোট্ট জগজিৎের গুনগুনে মুগ্ধ এক সাধু রেখেছিলেন জগজিৎ নাম।আসল নাম জগপ্রীত।
উত্তরাধিকার সূত্রেই গান মিশেছিল রক্তে। সুরের হাতে খড়ি বাবার কাছ থেকেই ।
হিন্দুস্তানি রাগ খেয়াল ও ঠুমরী-র তালিম পান উস্তাদ জামাল খাঁ-র কাছে।
১৯৬৭ তে পঁচিশ বছর বয়সি জগজিৎ আকাশবাণীর জলন্ধর স্টেশনে সুযোগ পেলেন ধ্রুপদী সঙ্গীত গাওয়ার। সেই অভিজ্ঞতা গলায় করেই মুম্বই আসা।
মাঝের গল্পটি যদিও আলাদা। বাবা পিডব্লুডি-র ইঞ্জিনিয়ার। সচ্ছল পরিবার। বাবার ইচ্ছে ছেলে হবে আইএএস । এ দিকে হঠাৎ কী খেয়ালে এমএ পড়তে পড়তে ছেড়ে দিয়ে ছেলে পঞ্জাবের শ্রীগঙ্গানগরের সুখী জীবন থেকে পালাল।
কী করবে? না,গান।
অতএব সোজা মুম্বই।পকেটে সাড়ে চারশো টাকা। পঁয়ত্রিশ টাকা ভাড়ায় একটা ঘরে অনেকে ‘শেয়ার’ করে থাকতেন। সে মধ্য ষাট দশকের গল্প। মুম্বইয়ে তখন গানের তারার ছড়াছড়ি। ফলে আকাশে ওঠা ছিলনা সহজ।
কঠিন সময়ও দিয়ে যায় কিছু নরম উপহার। প্রেম তেমনই এক অধ্যায়।
তাঁর ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হলনা। স্বপ্ননগরী তে তখন বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল গাইছেন আগামীর ঈশ্বর। কিছু প্লেব্যাকের সুযোগ আসতে থাকে।
সেই সুযোগই তাঁর চোখের সামনে মেলে ধরে জীবন সঙ্গিনী চিত্রা কে।
প্রেমের গল্পে পাতাঝরা যে ছিলনা তা নয়। চিত্রার ব্যক্তিগত জীবনেও এসেছিল কিছু জটিল মোড় ।
তবে অলিগলি পেরিয়ে দুজনের প্রেম রাজপথে হেঁটেছিল একসঙ্গে। বিবাহ ও সুরের বন্ধনে গিঁট বাঁধে দুজনের মন। সেই গিঁট থেকেই বেরিয়ে আসে প্রতিভাবান পুত্র সন্তান বিবেক ।
বিয়ের পরে নিজেদের আরও বেশি করে সঙ্গীতসাধনায় ডুবিয়ে দিলেন জগজিৎ-চিত্রা। অনুষ্ঠান, ব্যক্তিগত রেকর্ড, প্লেব্যাক।কখনও একসঙ্গে, কখনও একা।
জগজিৎ-চিত্রার গানে বুঁদ সাধারণ বসার ঘর থেকে অট্টালিকার ড্রয়িং রুম।
১৯৭৬ এ মুক্তি পেলঅ্যালবাম । দ্য আনফরগটেব্ল। বদলে গেল উপমহাদেশের গজল মানচিত্র।
জগজিৎ-চিত্রা যুগলবন্দী হয়ে উঠলো সাধারণের দুঃখ কথা।
‘দুনিয়া জিসে কেহতে হ্যায়’, ‘তুম কো দেখা তো ইয়ে খয়াল আয়া’, ‘বাবুল মোরা নাইহার’, ‘কোই সমঝেগা ক্যায়া রাজ’, ‘উস মোর সে শুরু করেঁ ফির ইয়ে জিন্দগি’, ‘দিল এ নাদান তুঝে হুয়া’, ‘বহোত পেহলে সে উন কদম’... সুরের বৃষ্টিতে আজও ভিজে ওঠে চোখের পাতা।
ভারতীয় রাগ, সঙ্গে পাশ্চাত্যের বেস গিটার। বারো তারের গিটার। পারকাস্ন ।মঞ্চ আলো করে জগজিৎ।প্রাচ্য পাশ্চাত্যের এই অভিনব সুরের বন্ধন জগজিৎের অন্যতম আর এক অবদান।
প্রেমের কবি মির্জা গালিবের কথাতেও সুরের প্রলেপ দিয়েছেন তিনি।১৯৯৮ এ সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার সেই কীর্তির স্বীকৃতি।
আঞ্চলিক ভাষাও সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর সুরারোপনে । বাংলা যার মধ্যে একটি। তৃষ্ণা অ্যালবামটি আজও আলো করে রেখেছে অনেক বাঙালির গানের আলমারি।
২০১১ সাল।ইংল্যান্ড সফরের পরে গুলাম আলির সঙ্গে অনুষ্ঠান করার কথা ছিল মুম্বইয়ে। তার আগেই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দু’সপ্তাহ কোমায় থাকার পরে সত্তর বছরে সুরের মায়াজাল ছিঁড়ে তাঁকে কেড়ে নেন মৃত্যু ।
তাঁর গানে তিনি অমর। অমর তাঁর কণ্ঠে। পৃথিবীর সব সত্যি মিথ্যে করে মৃত্যু যদি আরও একবার ফিরিয়ে দিত তাঁকে...এই দিনে।