ছ’বছর আগে শুরু হয়েছিল অর্জুনপুরের দত্তবাড়ির পুজো। ২০১২ সালে পাড়ার ক্লাবে থিম পুজো নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন প্রতিবেশীরা। বাধ্য হয়ে কৃষ্ণনগর থেকে ছোটো দূর্গামূর্তি নিয়ে আসলেও তা পছন্দ হয়নি পড়শিদের। খানিকটা রাগের বশেই ঐ মূর্তি বাড়ি নিয়ে চলে আসেন বাড়ির কর্তা, কামারহাটি পুরসভার ইঞ্জিনিয়ার তমাল দত্ত। পরের বছর থেকে বাড়িতেই সেই দুর্গা পূজিত হয়ে আসছে।
রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, অনন্ত পথের মধ্যে ঈশ্বরকে পাওয়ার সহজ পথ তাঁকে মাতৃরূপে আরাধনা করা। নিজ স্ত্রী সারদাদেবীকেও মাতৃরূপে অর্চনা করতেন তিনি। মূলত রামকৃষ্ণের পর থেকেই বাংলার দুর্গোৎসবে কুমারী পূজোর চল শুরু হয়। বাংলা ছাড়াও উত্তর ভারতের বেশ কিছু স্থানে কুমারী পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। অষ্টমীর দিন লাল বেনারসী ও স্বর্ণালংকারে সুসজ্জিত করে পূজো করা হয়ে থাকে চার বছরের শিশুকন্যাকে। সাধারণত বাংলার পূজোগুলিতে ব্রাহ্মণ পরিবারের শিশুকন্যাকেই এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়।
কাশ্মীর ভ্রমণের সময় এক মুসলিম মাঝির শিশুকন্যাকে কুমারীরূপে পূজো করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দের সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই প্রচলিত নিয়ম ভাঙলেন বাগুইআটির দত্ত পরিবার। তালতলার দত্তবাড়িতে এ বছর দূর্গাষ্টমীর দিন কালিকারূপে পূজিত হবে চার বছরের ফতেমা। প্রথম বছর থেকেই অষ্টমীতে কুমারী পূজো শুরু করেছিলেন তাঁরা। সে বছর ব্রাহ্মণ পরিবারের শিশুকন্যাকে পূজো করা হয়েছিল। স্বামীজির আদর্শকে পাথেয় করে পরে মত বদলান তমাল। পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কুমারী নির্বাচনে কোনো জাতপাতের গন্ডি থাকবে না। সেই কথা অনুসারেই ২০১৪ তে অব্রাহ্মণ পরিবারের শিশুকন্যা এবং তার পরের বছর ডোম পরিবারের শিশুকন্যাকে মাতৃরূপে পূজো হয় এ বাড়িতে।
প্রসঙ্গত, কুমারী পূজায় চার বছরের কন্যাকে নির্বাচন করার নেপথ্যে একটি বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে। এর ব্যাখ্যা করে রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, যেহেতু এই বয়সের শিশুরা বস্তুজগতের থেকে অনেক দূরে নিজের অন্তর্জগতে বাস করে, সেহেতু তাঁদের মাতৃরূপে অর্চনা করা যেতে পারে। কারণ অন্তর্জগতই ঈশ্বরের আশ্রয়স্থল। কিন্তু এর মধ্যে জাতপাতের কোনো প্রসঙ্গই আনেননি তিনি। তন্ত্রেও বলছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে যে কেউ সাধনা করতে পারে, ঈশ্বরই তাদের এই অধিকার প্রদান করে।
প্রতি বছরই পূজোর মাস দুয়েক আগে থেকে কুমারীর সন্ধানে বেড়িয়ে পড়েন অর্জুনপুরের দত্ত পরিবার। সম্প্রতি তাঁদের পরিচিত কামারহাটির বাসিন্দা মহম্মদ ইব্রাহিমের কাছে শিশুকন্যার খোঁজ করেন তমাল। তিনি জানিয়েছেন, জাতপাতের বেড়াজাল ভেঙ্গে বেরোনোই মূল লক্ষ্য ছিল। তাই অনেকের মতো ইব্রাহিমকেও বলেছিলাম পুজোর জন্য শিশুকন্যার খোঁজ দিতে, কিন্তু ওদের সম্মতি আদায়ের ব্যাপারে একটা সংশয় রয়ে গিয়েছিল।
প্রস্তাব পাওয়ার একদিনের মধ্যেই ভাগ্নি ফতেমার ছবি নিয়ে তমালকে পাঠিয়ে দেন ইব্রাহিম। পরিবারের সকলেই যে এ প্রস্তাবে রাজি, তা জানাতেও ভোলেন না। ফতেমার বাড়ি আগরায়। বাবা মহম্মদ তাহিরের দোকান রয়েছে। মা বসুরার সঙ্গে ফতেমা এখন তার মামাবাড়িতে রয়েছে। বিষয়টি ব্যক্ত করতে গিয়ে ইব্রাহিম বলেন, প্রস্তাবটি পেয়ে আমার পরিবারের সকলেই খুব খুশি, সঙ্গে সঙ্গে রাজিও হয়ে যাই। জাত-ধর্ম আলাদা হলেও ঈশ্বর তো আলাদা নন, তিনি এক।
জাতি-বর্ণ-লিঙ্গহীন যে ধর্মের কথা প্রচার করে গিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ, তাঁকে বাস্তবায়িত করে আগেই মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন বাগুইআটির দত্ত পরিবার, এবার তাদের সহায়তায় ফতেমার পরিবারও শামিল হলেন এই মহাযজ্ঞে।