গতানুগতিকতার শৃংখল মুক্তি

গুপী-বাঘার গল্পে হাল্লার রাজার স্বেচ্ছাচারিতার দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার পর জনৈক ব্যক্তির সেই 'ছুটি-ছুটি' উল্লাস আমাদের অনেকের মনেই এখনো গেঁথে আছে। আসলে দমবন্ধকর যেকোনো পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মানেই ডানা মেলার সুযোগ। হুল্লোড়ের আশ্বাস। খোলা আকাশের মতোই বিস্তার তার। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় সেখানে। এই যেমন একটা আণুবীক্ষণিক বীজাণু গৃহবন্দী করে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে বিপন্ন করে তুলেছে, তার থেকে মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনছি আমরা। মনে-মনে অনেকেই চাতক পাখির মতো ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় আছি আর পরিকল্পনার জাল বুনে চলেছি যে, একবার সুযোগ পেলে কোথায় কিভাবে সাধ্যমত বেড়াতে যাওয়া যায়। বেড়াতে যাওয়া মানেই গতানুগতিকতার একঘেয়েমি থেকে মুক্তি। এক ঝলক টাটকা বাতাস। নিত্যদিনের অভ্যেস যখন বোরডমের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে আমাদের, টুক করে কোথাও ঘুরে আসা যেন ঠিক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। ঠাণ্ডা বাতাসের মতো স্নিগ্ধ করে জীবনকে। জীবনের ভাঙ্গা-গড়ায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠা দিনগুলো আমাদের কোথাও থমকে দেয়। দিন-রাত এগিয়ে চলে কালের নিয়মে। কিন্তু সেই অনভিপ্রেত গতানুগতিকতায় মানুষ আটকে পড়ে। না চাইলেও তাতে আটকা পড়ে যায়। সেই বন্দীদশা থেকে মুক্তির আস্বাদ খুঁজতে থাকা মানুষের কাছে বেড়াতে যাওয়া পথ্যেরই সমান। তাইতো বাংলা সাহিত্যের দুঁদে গোয়েন্দারা তাদের মস্তিষ্ক সচল রাখতে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়তেন। কত সাহিত্যিকরা তাঁদের সৃষ্টির খোরাক খুঁজে পেয়েছেন বেড়ানোর মাধ্যমে। রোজকার অভ্যাসএর সঙ্গ ছেড়ে তবেই নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পেরেছেন। রোজ জঙ্গলে একই পথে কাঠ কাটতে যাওয়া কাঠুরেটি যেমন ঈশ্বরের প্রসন্নতায় সোনার কাস্তে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন, বেড়ানো তেমনি প্রকৃতির বর দান। রোজ দশটা পাঁচটার চাকরির যাঁতাকলে পিষতে থাকা মানুষটা যখন তার মনের এক টুকরো সবুজকে হারিয়ে ফেলে, তাঁর কাছে অভ্যাসের দাসত্ব থেকে মুক্তি মানে 'চির নূতনের ডাক'। প্রকৃতির ডাকেই সেই মানুষটা নতুন করে খুঁজে পায় নিজেকে।মনের আকাশে মেঘ জমলে বড়ই মুশকিল। বেড়ানো মানে মনের মেঘময় আকাশে বৃষ্টির স্নিগ্ধ ধারা। অফিস, কেরিয়ার,সংসার দশ হাতে সামলানো মেয়েটা একেবারে নিজস্ব একটা পৃথিবী খুঁজে পায় বেড়াতে গেলে। সেখানে তাঁর প্রয়োজন মেটায় খোলা আকাশ, মুক্ত বাতাস। নিজের প্রয়োজনীয় আড়াল খুঁজে পেতে বেড়ানোর জুড়ি মেলা ভার। কর্মদক্ষতা থাকা সত্ত্বেও আশানুরূপ ফল না পেয়ে হতাশ কর্মীদের মন খারাপের ওষুধ মানে ঘুরতে যাওয়া। বসের তিরস্কারে তিতিবিরক্ত মানুষটার সব ক্ষোভ, যন্ত্রণা মোছার মাধ্যম হলো ভ্রমণ। জীবনের অভ্যেসগুলো আমাদের যান্ত্রিক করে দেয় কখনো কখনো। আমরা তাদের ছাড়তেও পারি না আবার মনের পূর্ণ ভালোবাসা দিয়ে তাদের গ্রহণও করি না। শুধু অভ্যেসের বোতাম টিপে কাজগুলো করতে থাকি। ফলে এই যান্ত্রিকতাই সব আবেগ,অনুভূতি নিংড়ে নেয়। মানুষের অনুভূতির নিজস্ব ভাষা থাকে। তাদের বাকশক্তি আমাদের কথ্যভাষার থেকেও প্রখর। এই মনের ভাষার ক্ষমতা থাকে আমাদের আত্মাকে ছোঁয়ার। সেই আত্মোপলব্ধির সঠিক পন্থা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম।আমাদের প্রতিনিয়ত চলতে থাকা জীবনচর্যা কখনো সেই আত্মোপলব্ধির পথে বাধা হয়ে দাড়ালে, মুক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় কিন্তু বেড়াতে যাওয়া। অবশ্যই ভ্রমণ প্রেমী মানুষদের কাছে। সে মুক্তি সাময়িক হলেও তা আমাদের মনের মলিনতা মুছে খুশির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। তাই ঘরে থাকা মানা সিরিজের অন্তিম পর্বে অভ্যেসের দাসত্ব-মুক্তির পথ সামান্য পরিসরে খোঁজার চেষ্টা করলাম আমরা।

hill-body

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...