ইতিহাসে কোয়ারেন্টাইন

ইতিহাসে কোয়ারেন্টাইন

চল্লিশ সংখ্যাটিকে ইতালির ভাষায় বলা হয় 'কোয়ারানতা'। আর সময় মানে 'তিনো'। অর্থাৎ চল্লিশ দিন নির্জনে! পৃথিবীর বয়স অনেক। কিন্তু সে তো চিরসবুজ। চিরঞ্জীবী। আসলে এমনটাই ভাবতেন সকলে। তারও যে শরীর খারাপ হতে পারে, সেটা আমল দেননি কেউই।

করোনা ভাইরাসের জেরে স্তব্ধ মানবজগত। গৃহবন্দী দশা কাটাচ্ছেন সমস্ত মানুষ। নিরুপায় সকলে। বাইরে পা রাখলেই, দেহে অনুপ্রবেশ ভাইরাসের। মহামারির আবহে আতঙ্কই এখন সকলের রোজনামচা। করোনা আক্রান্ত সব দেশ গুলিই এই মুহূর্তে বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। কোয়ারেন্টাইন আর আইসোলেশন। এই দু’টিই করোনা-আক্রান্ত বা করোনা-সন্দেহে চিহ্নিতদের গন্তব্য এখন। তবুও অনেকে জানেননা এই দুই শব্দের প্রয়োগ।

গত বছর ডিসেম্বর মাসে চিনের হুবেই প্রদেশে শুরু হওয়া এই সংক্রমণ যখন এক মাসের মধ্যে বিভিন্ন দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন শোনা যাচ্ছিল, দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের মানুষ কোয়ারেন্টাইনের আশ্রয় নিয়েছেন। চোদ্দো শতকের ইউরোপ। মহামারির আকার নেয় ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ। তখন বন্দর-শহর ভেনিসের তরফে একটি বিশেষ নিয়ম জারি করা হয়।

ইতালি। ঘরবন্দী সব্বাই। এরকমই চেনা সৌন্দর্যের একটা গলি। অন্য ভবে হলো মাতোয়ারা। একজন তাঁর ঝুল বারান্দায় সাধের চেলো টা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। বেশ কিছুদিন না বাজানোয় একটু ফ্যাকাশে হয়েছে সেটার রঙ। ঐভাবে ফেলে রাখা যায় যখন মন ভালো নেই পৃথিবীর। হাওয়ায় জানান দিয়ে ধরলেন ' বেলা চিয়াও ' এর সুর। সেই সুর মিলিয়ে একে একে বিভিন্ন ঘর থেকে ভেসে আসতে থাকে অন্যান্য যন্ত্রানুষঙ্গে সেই একই গান। লেখা হয়ে থাকে মানবজাতির ইতিহাসের এক রঙিন ও ঐতিহাসিক অধ্যায়। এই প্রথমবার।

করোনা ভাইরাস অনেক প্রাণের বলি কেটেছে পৃথিবীর বুক চিড়ে। কিন্তু একইসঙ্গে মানুষ কে ফিরিয়ে দিয়েছে তাঁর হারিয়ে যাওয়া একাত্মতার সুর। বন্দরে কোনও বিদেশি জাহাজ এলে, বা দেশের জাহাজ অন্য কোথাও বাণিজ্য করে ফিরলে, তীরে ভিড়িয়ে যাত্রীদের নামানোর আগে সেটাকে নোঙর করে সমুদ্রেই রেখে দিতে হবে চল্লিশ দিন। কারণ এই চল্লিশ দিন হচ্ছে অসুখের ইনকিউবেশন পিরিয়ড। কেউ সংক্রামিত হলে তা এই চল্লিশ দিনেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, তখনই তাকে আলাদা করে ফেলা যাবে। তার আগে অবধি জাহাজ-ভরা প্রতিটি মানুষই সম্ভাব্য সংক্রামিত, যার থেকে রোগ ছড়াতে পারে।

তখন প্রযুক্তি ও চিকিৎসা এত উন্নত ছিল না। সহজে পরীক্ষা করে রোগ ধরারও উপায় ছিল না। ফলে কোনও রকম ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এই চল্লিশ দিনের অবরুদ্ধ দশাই রক্ষাকবচ ছিল। চল্লিশ সংখ্যাটিকে ইতালির ভাষায় বলা হয় ‘কোয়ারানতা’। আর সময় মানে ইতালিতে ‘তিনো’। ফলে এই অপেক্ষার সময়টিকে তারা বলতো কোয়ারান-তিনো। সেই থেকে এসেছে কোয়ারেন্টিন বা কোয়ারেন্টাইন শব্দটি।

যখন কারও মধ্যে জীবাণুর উপস্থিতি নিশ্চিত ভাবে ধরা পড়বে, অথবা ধরা না পড়লেও উপসর্গ থাকবে তাকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তখন তাকে শুধু বন্দি থাকার নিদান দিলে হবে না, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। আর এই অবস্থা হলো আইসোলেশন। অসুস্থ ব্যক্তিকে পরিবার থেকে আলাদা রেখে যত্ন নেওয়া বা চিকিৎসার ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরনো। এ সংক্রান্ত সবচেয়ে পুরনো প্রমাণ ধরা হয় ‘বুক অব লেভিটিকাস’ বইটিকে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮-৩৩২ সময়ে লেখা হয়েছে। সেখানকার তথ্য অনুযায়ী, যেসব ব্যক্তির লেপ্রসি বা কুষ্ঠরোগ হতো তাদের সমাজ ও পরিবার থেকে আলাদা করে রাখা হতো।

পরবর্তীকালে ১৯১৮ সালে যখন বিশ্বজুড়ে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারি আকার ধারণ করল, তখন আমেরিকা ও ইউরোপের স্বাস্থ্যকর্মীরা একযোগে দাবি করল যে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা রাখতে হবে। কারণ, ভাইরাস বাতাস, কফ ও থুতুর মাধ্যমে ছড়ায়। সেই সময় আমেরিকার জনস্বাস্থ্য অ্যাসোসিয়েশন সিদ্ধান্ত নিল যে যাদের অবস্থা গুরুতর তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হবে আর যাদের অবস্থা গুরুতর নয় তারা বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিতে পারবেন।

এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কোয়ারেন্টাইনকে আইনের মধ্যে নিয়ে এসে একে বাধ্যতামূলক করে এবং যদি কেউ এই আইন ভঙ্গ করে তার জন্য শাস্তির বিধান রাখে। বর্তমান সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম জুড়ে যেমন করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ছে, একইভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সেলেবদের কোয়ারেন্টাইন যাপনের খবর। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ছবি ও ভিডিও গুলি জ্যান্ত দলিল। দেশ এখন আশাবাদী এই অবস্থা সকলে কাটিয়ে উঠতে পারবে। সকলেই লড়াই করছে সংঘবদ্ধভাবে। রোজ নতুন নতুন পন্থা বেরোচ্ছে গৃহদশা যাপনের। ফিরে আসছে ফেলে আসা দিনের অনেক অভ্যাসও।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...