মহম্মদ আলি পার্ক। উল্টো ফুটপাতেই নাখোদা মসজিদের গলি। কলুটোলা। সেখান থেকে সোজা রাস্তা চলে গিয়েছে জাকারিয়া স্ট্রিট। রমজানের কলকাতার অন্যতম সেরা আকর্ষণ জাকারিয়া স্ট্রিট। দুর্গাপুজোর যেমন ধর্মতলা, গড়িয়াহাট। ক্রিসমাসের যেমন পার্ক স্ট্রিট ঈদের তেমন জাকারিয়া স্ট্রিট। এই রাস্তার উল্টো প্রান্ত চিৎপুর মিশেছে। তাই চিৎপুর দিয়েও জাকারিয়া স্ট্রিট আসা যায়। ফিয়ার্স লেন, কলুটোলা’র দিক থেকেও। নাখোদা মসজিদ এই রাস্তাতেই। লোয়ার চিৎপুর আর রবীন্দ্র সরণীর কাছে। কলকাতা তো বটেই, সারা পূর্ব ভারতের সব চেয়ে বড় মসজিদ। আগ্রার সিক্রায় অবস্থিত সম্রাট আকবরের সমাধির অনুকরণে ১৯৩৪ সালে তৈরি। সেই সময়ের হিসাবে ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল এই মসজিদ তৈরিতে। এই মসজিদের প্রথম মোতিয়ালি মানে মসজিদ প্রধান ছিলেন হাজি নূর মহম্মদ জাকারিয়া। তিনি এই কসমোপলিটন এলাকায় বিভিন্ন জনসেবার কাজে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর স্মৃতিতে রাস্তাটির নাম হয় ‘জাকারিয়া স্ট্রিট’।
সানাই লিজেন্ড আলি আহমেদ হুসেন থাকতেন এই অঞ্চলেই। এক ভাড়া বাড়িতে। দূরদর্শনের সিগনেচার টিউন বাজিয়ে ছিলেন তিনি। কম্পোজ করেছিলেন আর এক লিজেন্ড। পণ্ডিত রবিশংকর।
রমজান মাস পড়লে রাতারাতি পুরো চেহারাটাই পালটে যায় অঞ্চলটার। পুরনো হাভেলি, ইমারত, লাল ইঁটের এবড়োখেবড়ো দেওয়াল। আতর, সুর্মা, কাচের চুড়ির রিনরিন। হাওয়ায় ভেসে আসা নমাজের সুর। মিলেমিশে অদ্ভুত এক সুফি আমেজ ভেসে বেড়ায় অলিগলি জুড়ে। মসজিদের মাথায় রোদের রেখারা পাতলা হতে শুরু করলে ঘন হয়ে ওঠে ইফতারি ব্যস্ততা। কাবাব, কোর্মা, বিরিয়ানি, হালিম এর গন্ধে ম ম করে চারপাশ। রাস্তার ধারে ধারে ফলের পসরা। শালপাতা বিছানো ট্রে, তার ওপর তরমুজ, খরমুজা, পেঁপে, কলা, আনারস। নানা রকম তেলেভাজা, সঙ্গে শশা- পেঁয়াজ-কাচালঙ্কা দেওয়া ছোলার চাট।
তার মধ্যেই ঈদের কেনাকাটি। জামা, জুতো, আতর, সুরমা কার্পেটের দরদাম। কিন্তু জাকারিয়া স্ট্রিটের সব চেয়ে বড় আকর্ষণ সেখানকার খাবার। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত রোজা অর্থাৎ উপবাসে থাকার পর মাগরবি নমাজ শেষে উপবাস ভঙ্গ করেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। রুহ আফজায় গলা ভিজিয়ে শুরু হয় ইফতার। লাল রঙের ঠাণ্ডা পানীয়। গলা দিয়ে নামলেই গোলাপের সুবাস। বাজারে রূহ আফজার টান থাকলেও এখানে কিন্তু তার কোনও ছাপ চোখে পড়ল না।
জাকারিয়ার মুখেই পাশাপাশি দুই ফুড জয়েন্ট ‘দিল্লি-৬’ আর ‘তাস্কিন’। জাকারিয়া স্ট্রিটের সবচেয়ে জমজমাট ভিড়টা এখানেই। রাস্তার ওপর কাবাব কাউন্টার। রাস্তার ওপর টেবিল চেয়ার পেতে খাওয়া চলে। উল্টোদিকেই পুরনো দাওয়াখানা। সামনের ফুটপাতে পাঁউরুটি আর খাস্তা বিস্কুটের স্টল। বখরখানি, রগিনি রুটি, শিরমাল, নানা রকম নাম। মাংসের নানা রকম পদ দিয়ে খাওয়া যাবে। মেওয়া ঠাসা পাঁউরুটি। সিমাই আর লাচ্চায় রঙের বাহার। নজর টানবেই।
‘তাস্কিন’ বিখ্যাত তাদের বিখ্যাত ডিশ ‘চেঙ্গিজ চিকেন’ আর ‘মাহি আকবরির’র জন্য।
‘চেঙ্গিজ চিকেন’ মশলা দিয়ে ম্যারিনেট করা ভাজা চিকেন। চেঙ্গিজ খান এই পদের জনক। শুধু রমজানের সময়ই পাওয়া যায়।
ফিশ ফ্রাই নয়। মাছ ভাজা। মাহি আকবরি। আকবর খেতেন কিনা জানা নেই। তবে মাছ দেখলেই যাদের জিভে জল আসে তাদের বড় প্রিয়। বড় সাইজের রুই, কাতলা। গায়ে দই- হলুদ আর মশলা মাখানো। বিক্রি ওজনে। দরদাম মেটানোর পর কেটে পিস করে সরষের তেলে ভাজা। মাছের মাথাও ভাজা পাওয়া যায়। ধনেপাতা আর পুদিনার চাটনি দিয়ে সার্ভ। আছে বাগদা চিংড়িও। এভাবেই পেয়ে যাবেন।
ফিয়ার্স লেনে ১০০ বছরের পুরনো আদমস কাবাব শপে সুতলি কাবাব। ফিয়ার্স লেনের উল্টো দিকের গ্লিতা ধরে এগোলে দিলসাদ আহমেদের দোকান। খেতেই হবে খিরি কাবাব। পুরনো হোটেল জিশান ফেলে একটু এগোলে ‘বোম্বে হোটেল’। খাদ্যরসিকদের মতে, কলকাতার সেরা বিফ চাঁপ এখানেই পাওয়া যায়। আছে নানা স্বাদের, নানা নামের হালিম।
মিষ্টিও আছে নানা রকম। ফালুদা, ফিরনি, শাহী টুকরা। কোনওটা হলুদ কোনওটা সাদা। কোনওটাতে গোলাপি রেশ। আছে অমৃতি। কুচো সাইজের জিলিপিও। এই ধরণের কুচো জিলিপি কলকাতার অন্য অঞ্চলে খুব একটা দেখা যায় না।
জাকারিয়া ছাড়িয়ে খানিকটা ভিতরের দিকে এগোলে ফিয়ার্স লেন। গুলাব জামুন, মেওয়া লাড্ডু, বত্তিশার ভিড় গলি জুড়ে। ‘আফলাতুন’ আর ‘আলাউদ্দিন’ এখানকার দুই বিখ্যাত মিষ্টি পদ। ‘আফলাতুন’ কাগজে মোড়া হলুদ হালুয়ার মত এক ধরণের মিষ্টি। আর আলাউদ্দিন লাড্ডু।
যত সন্ধে ঘনায় তত বাড়তে থাকে ভিড়। ইফতারের আয়োজনের সঙ্গে জল আর শরবতদান। বরফের ধুপ ওঠা গোলাপি শরবতের গ্লাস। এক নিঃশ্বাসে গ্লাস শেষ হয়ে গেলেও গোলাপ গন্ধটা অনেকক্ষণ লেগে থাকে হাতে। এ গন্ধ উৎসবের। পরবের। আনন্দের। সেখানে কোনও বিভেদ নেই…