আবহমান ঋতুপর্ণ

চলচ্চিত্রের আপাত দুটো ধারা স্পষ্ট হয়, এক যেটির মধ্যে অতিমানবীয়তা থাকে। আর অন্যটিতে থাকে বাস্তবতা। গল্প যাই হোক, ছবি আদ্যন্ত শিল্প মাধ্যম। বাংলা বরাবর নানা বিধ শিল্পক্ষেত্রে দেশকে পথ দেখিয়ে গিয়েছে। চলচ্চিত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হীরালাল, প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকী বসু থেকে শুরু করে সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল, তপন সিনহারা বাংলা ছবিকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় একবিংশ শতকের প্রথম দশক অবধি, বাংলা ছবি এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। তরুণ মজুমদার, প্রভাত রায়, গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত, অপর্ণা সেনরা সিনেমা বানাচ্ছিলেন বটে কিন্তু ক্রমশই চেপে বসছিল সেই অতিনাটকীয়তাময় ছবিগুলির দাপট। যে ধারার নাম রেখেছি বাণিজ্যিক ছবি। আম আদমি দেখার পপুলিস্ট ছবি। সেখানেই একদিন ঋতুর আগমণ হল। এক মাথা ঝাঁকড়া চুলের এক ছেলে, বাচনভঙ্গি নারীসুলভ। আচরণও খানিকটা তাই। বিজ্ঞাপন জগৎ থেকে সত্যিজিতের মতোই তার ছবি বানাতে এসে পরা।
 
হীরের আংটি বেরুলো, ঋতু নিজেই লিখে গিয়েছেন বারবার খসড়া পাল্টে বহু যত্ন করে সে ওই ছবি চিত্রনাট্য লিখেছিল। কিন্তু সেভাবে ছবিটা দেখল না কেউ। কিন্তু আগমণে একটা ধাক্কা দিয়েছিল ঋতু। ওই ধাক্কার নামই ঋতুপর্ণ। তারপর এসে আবার সাহিত্যকে তুলে আনল ছবির প্রেক্ষাপট করে। সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে এল ছবিতে। বাবা-মা-সন্তান, স্বামী-স্ত্রী একেক রকম মোড়কে একেক সম্পর্কে দেখাতে শুরু করল সে, আঙ্গিক বদলে গেল ছবি। হঠাৎ করে সুইজারল্যান্ডে গিয়ে নাচতে আরম্ভ করা, এক নায়কের একশো জনকে প্রহার ছেড়ে আবার বাংলা ছবির দর্শক বাস্তবতায় ফিরতে শুরু করল। নায়ক গোটা ছবিতে শুয়ে থাকলেও লোক তা দেখল, মেনে নিল, সানন্দে গ্রহণও করল। লাইটস, ক্যামেরা, অ্যাক্শনের প্রতি যথার্থ বিচার হল। বাংলা ছবির ক্যানভাস বদলালো। নতুন নতুন জিনিসকে বাংলা বারংবার গ্রহণ করেছে, এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। স্ক্রিনপ্লেটা বদলে গেল, দৃশ্যে যেসব জিনিস ব্যবহার হত তার মধ্যেও রুচিবোধের ছোঁয়া মিলতে শুরু হল। শিল্পবোধ দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল, সেখান থেকেই আস্তে আস্তে পাল্টে গেল আর্ট ফিল্ম সমন্ধে সাধারণ মানুষের ধারণা। তার মধ্যে যে সর্বজনবোধ্য একটি গল্প থাকতে পারে, তা বোধহয় ঋতুপর্ণই বিশ্বাস করলেন। সে মুহূর্ত থেকে তথাকথিত ম্যাসেজওয়ালা আর্ট ফিল্ম পপুলিস্ট সিনেমায় পরিণত হল। আক্ষরিক অর্থে একবিংশ শতকে বাংলা ছবির পুনর্জাগরণের পুরোধা তিনিই। ওঁর ছবিকে ঘিরেই বাংলার ছবির পুনর্জন্ম। আদপে সব শিল্পের লক্ষ্যই উপার্জন। শিল্পের সেই আদি অকৃত্রিম উদ্দেশ্যও পূরণ করে গিয়েছেন ঋতুপর্ণ।
 
তবে আরও একটি জিনিস ঋতু করেছেন, তার জন্যে বাংলা ছবি অনেকটাই কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে, সেটি হল ছবিকে প্রাপ্তবয়স্ক করে তোলা। প্রাপ্তমনস্ক দর্শকমহল তৈরি করা। যৌনতা, সমকামিতা, এগুলো নিয়ে আমাদের ছুঁতমার্গ রয়েছে, নাক সিটকানো, ভ্রু কুঁচকানো ছিলই, আছেও! কিন্তু তাও বাংলা ছবিতে সেই দিগন্তকে উন্মোচিত করেছিলেন তিনি। সাবলম্বী হয়েছিল ছবি। এক অন্য স্বাদের, চিরাচরিত ধাঁচের বাইরে বেরিয়ে এসে এক ঘরানার ছবি তৈরি করে গিয়েছেন ঋতুপর্ণ। দর্শক নিয়মিত সেই ঘরানার স্বাদ পেয়েছে, অন্য ধারার ছবি নিয়মিত এক বিপুল সংখ্যক দর্শক পেয়েছে। দর্শকরাও তাতে অভ্যস্ত হয়েছেন, সেটাই আজকের বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে। পরিচালক, নির্মাতা, প্রযোজকরা তেমন ধারার ছবি বানানোর সাহস করছেন। সেই সাহসের নাম ঋতুপর্ণ, বাংলা ছবির আবহমান ধারার নাম ঋতুপর্ণ।
 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...