আমরা ছোটবেলা থেকেই পড়ে আসছি জলের আর এক নাম জীবন। চাঁদে অথবা মঙ্গল গ্রহে চলছে জলের খোঁজ। কারণ জলের সন্ধান পাওয়া গেলেই প্রাণের সন্ধান পাওয়া যাবে। পাশাপাশি জল থাকলেই সেখানে মানুষের বসবাসের অসুবিধে হবেনা। কিন্তু ভাবুন তো, জল আছে অথচ প্রাণ নেই। অবাক হবার মত বিষয়ই বটে। জল থাকবে কিন্তু প্রাণ থাকবে না, তা আবার হয় নাকি? হ্যাঁ। এমনটাই ঘটে চলেছে ইথিওপিয়ার উত্তরে দাল্লোল শহরের ডানাকিল ডিপ্রেশনে।
দাল্লোরের ড্যানিয়েল ডিপ্রেশনের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে রয়েছে অজস্র উষ্ণ প্রস্রবণ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই এলাকা প্রায় ১৩০ মিটার বা ৪৩০ ফুট নিচে অবস্থিত। জলে অ্যাসিড রয়েছে বলে এখানে মাছ জন্মায় না। এই ডিপ্রেশনের বিস্তৃত এলাকা প্রাণহীন। একটা সময় বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, এমন চরম আবহাওয়ায় একমাত্র অণুজীবরাই বেঁচে থাকতে পারে। পরবর্তীকালে গবেষণা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে, অণুজীব-ই নয় কোনও রকম কোনও প্রাণ-ই জন্মাতে পারবেনা এই পরিবেশে। চারদিক সবুজে ঘেরা অথচ কোনও এক বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে দমবন্ধ করা পরিবেশ। কিছু কিছু এমনও জায়গা আছে যেখানে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত। উত্তাপ যেন লাগামছাড়া। জল ভর্তি হয়ে রয়েছে ম্যাগনেশিয়ামে। স্থানে স্থানে অ্যাসিড ভর্তি পুকুর টগবগ করে ফুটছে। জায়গাটির রহস্যভেদ করতে গিয়ে নাকি মৃত্যু হয়েছে অনেক বিজ্ঞানীর।
জানা গেছে, দাল্লোলে এক সময় জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি ছিল। প্রতিনিয়ত লাভা বেরিয়ে আসত বাইরে। জলের সঙ্গে মিশে যেত সেই লাভাস্রোত। সেই স্রোত ছড়িয়ে পড়ে স্থলভূমিতেও। গঠিত হয় নানা রকম ছোট বড় গর্ত। পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম এবং আরও নানান খনিজ দ্রবীভূত হয়ে জমা হয় এই গর্তে। এখানকার জলের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে জলে নানারকম বিষাক্ত পদার্থ মিশে আছে। এই এলাকা সাংঘাতিক চরমভাবাপন্ন। এমনই তার ভয়াবহতা, যে এখানে ব্যাকটেরিয়া থাকাও সম্ভব নয়। এখানকার বিষয়ে সবিস্তারে জানতে গেলে সেখানে থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। যেটা কোনোওভাবেই সম্ভব নয়। এখানে এসে নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়েই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অনেক বিজ্ঞানী। এখানকার গড় তাপমাত্রা ৪৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। শীতকালেও দিনের বেলার তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। যে কোনও সময় তাপমাত্রার যথেষ্ট অদল বদল হয় এখানে। ইথিওপিয়ায় আসা পর্যটকদের দাল্লোলের চারপাশ ঘুরিয়ে দেখানো হয়। তবে ডিপ্রেশনের মূল এলাকায় পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার সাহস দেখান না ট্যুর গাইডরা।
ফ্রান্সের 'ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চে'র বিজ্ঞানীরা বহুকাল ধরে রিসার্চ চালাচ্ছে এলাকায় প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না, সে বিষয়ে জানার জন্য। মুখ্য গবেষক পিউরিফিসিয়োঁ লোপে গার্সিয়া জানান, অতিরিক্ত অ্যাসিড ও ক্ষার মিশে আছে এই এলাকার চারদিকে। সেই সঙ্গে রয়েছে খনিজ লবনের প্রাচুর্য। তাঁর মতে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই প্রাণ তৈরীর পথে মূল বাধা। নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন নামক একটি বিজ্ঞান পত্রিকায় দাল্লোরের এই জায়গার কথা জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে প্রাণ থাকে আর নাই থাক, জায়গাটির বৈশিষ্ট্য কোনওমতেই অস্বীকার করা যায় না। আমাদের জ্ঞানের সীমাকে আরও প্রসারিত করেছে এই ডিপ্রেশন, যেখানে দেখা যাচ্ছে, জল থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় আবহাওয়া তথা রাসায়নিক দ্রবিভূতের সংমিশ্রণ যথাযথ না থাকায় প্রাণের সঞ্চার হচ্ছেনা।
তবে পর্যটক যাঁরা ইথিওপিয়ায় যাচ্ছেন, তাঁঁরা একবার অবশ্যই এই জায়গায় ঘুরতে আসেন এবং জানা গেছে, মূল জায়গায় প্রবেশ করতে না পারলেও পর্যটকেরা ওই এলাকার সৌন্দর্য যথেষ্ট উপভোগ করেন|