এই যে আমরা নারী স্বাধীনতা, স্বাধীন অস্তিত্বের কথা বলি, তার ভিত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৭সালের ১৫ই আগস্ট ভারতের দীর্ঘ কাঙ্খিত স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তার পিছনে শুধু কিছু চিরাচরিত উল্লেখিত নামের ভূমিকা ছিল তা নয়, বহু নারীর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে এক্ষেত্রে গান্ধীজির অবদান কিছুটা হলেও বেশি। কারণ তাঁর রাজনীতিতে আগমনের পর স্বাধীনতা আন্দোলন চেনা গন্ডি ছেড়ে গণ অভ্যুথানের পথে অগ্রসর হয়, তিনি তার ভাবাদর্শ সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেন। ফলতঃ এক্কেবারে তৃণমূল স্তরে পুঁথিগত শিক্ষাহীন, দারিদ্রের সাথে লড়াই করা মানুষগুলো এই আন্দোলনে এগিয়ে আসে। প্রতিবাদ করতে গেলে যে ইচ্ছেশক্তির জোর লাগে তার নজির স্থাপন করেছিলেন বেশ কিছু নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী। আরো উল্লেখ্য যে, এই আন্দোলনের ধারাকে সর্বস্তরে তরঙ্গায়িত করতে এই নারীদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। আজ এমন দুজনের কথা বলবো তাদের অবদান, উত্থানের ভিত এক্কেবারে ভিন্ন। আর বিখ্যাত কারণ বাংলায় প্রথম এই দুই নারী স্বাধীনতা সংগ্রামীর সম্মাননায় তাদের নামে উৎস্বর্গীকৃত হয়েছে পূর্ব রেল বিভাগের দুটি স্টেশন।
এবার তাঁদের কথায় আসি । প্রথমজন দারিদ্র , স্বল্প বয়েসে বৈধব্য যন্ত্রনাকে উপেক্ষা করে গান্ধীর আদর্শে এতটাই অনুপ্রাণিত হন যে গান্ধী বুড়ি নামেই তার পরিচিত হয়। তিনি মাতঙ্গিনী হাজরা।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রত্যক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মাতঙ্গিনী হাজরা। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মাতঙ্গিনী লবণ আইন অমান্য করে গ্রেফতার হন। মুক্তি লাভের পর তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্যপদ লাভ করেন এবং নিজের হাতে চরকা কেটে খাদি কাপড় বানাতেও শুরু করেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি শ্রীরামপুরে কংগ্রেস অধিবেশনে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন। সে যাত্রায় রক্ষা পেলেও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ৭৩ বছর বয়সী মাতঙ্গিনী হাজরার নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয় ছয় হাজার সমর্থক নিয়ে তমলুক থানা দখলের উদ্দেশ্যে। শহরের উপকণ্ঠে মিছিল পৌঁছালে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৪ ধারা অমান্য করে মাতঙ্গিনী অগ্রসর হলে তাঁকে গুলি করা হয়। কংগ্রেসের পতাকাটি মুঠোর মধ্যে শক্ত করে উঁচিয়ে ধরে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শেষ হয় এক অধ্যায়। আর তাঁর প্রতি সম্মাননায় তৈরী হয় শহিদ মাতঙ্গিনী হাজরা রেলওয়ে স্টেশন। এটি তমলুক ও পার্শবর্তী এলাকায় পরিষেবা প্রদান করে।
এবার যার কথা বলবো সক্রিয় রাজনীতিতে তাঁর আগমন পারিবারিক সূত্রেই। তিনি বেলা বসু মিত্র, আর একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যায় গেলে বলা যায় ইনি ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাইঝি। ১৯৪০সালে নেতাজী কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশন ত্যাগ করে আপোষ বিরোধী আন্দোলনের ডাক দিলে বেলা বসু ছিলেন তার প্রধান। এছাড়া ১৯৪৪এ আজাদ হিন্দ বাহিনীর পূর্ব এশিয়ার গুপ্তদলগুলির সাথে যোগাযোগ, সংবাদ আদান প্রদানের গুরু দায়িত্ত্বে ছিলেন তিনি।
১৯৪৭এ স্বাধীনতার পর তিনি ঝাঁসির রানী সেবাদল গঠন করে উদ্বাস্তুদের সেবায় নিয়োজিত হন। তাদের উন্নয়নেই বালি- ডানকুনির কাছে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। তাঁর জন্মদিনে পূর্বরেলের পক্ষ থেকে হাওড়া –বর্ধমান কর্ডলাইনের স্টেশনের নাম বেলা নগর রাখা হয়। এটাই প্রথম ভারতীয় কোনো নারীর নামে নামাঙ্কিত স্টেশন। বলতে দ্বিধা নেই এই দুই নারীর আত্মত্যাগের প্রতি পূর্বরেলওয়ে তথা ভারত সরকারের এই উদ্যোগ সত্যি প্রসংশনীয়।