পলাশীর লুণ্ঠনের স্মৃতিচারক এই রাজবাড়ী

 

                                কলকাতা থেকে সড়কপথে এক থেকে দেড় ঘণ্টায়  হাওড়ার   মৌরিগ্রাম গ্রাম  ছাড়ালেই আন্দুল। আন্দুল মানেই এক ১৮৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী  রাজবাড়ি। শোনা যায় একসময় নাকি সরস্বতী নদীর স্রোত এই প্রাঙ্গণ পর্যন্ত  বিচরণ করত। এখন কোথায় সেই নদী !  বাড়ির সামনে বিরাট খোলা প্রাঙ্গণ। যাই হোক  এই রাজবাড়ির একটা ঐতিহাসিক সত্যতা আছে।  ১৭৫৭  সালে  পলাশীর  যুদ্ধের পর সিরাজের বিপুল সম্পত্তি কব্জা করে ইংরেজরা লুঠ হয়েছিল প্রচুর সম্পত্তি।  নবাবের দেওয়ান ছিলেন রামচন্দ্র রায়। প্রায় ২টি বজরা করে বিপুল সম্পত্তি নিয়ে গঙ্গা হয়ে আন্দুলে নোঙ্গর ফেলেন  তিনি। লর্ড ক্লাইভের বদান্যতায় আন্দুলে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। তার পুত্র ছিলেন রামলোচন রায় তাঁর হাত ধরেই আন্দুল রাজ পরিবারের সৃষ্টি হয়। তিনি ছিলেন লর্ড ক্লাইভের দেওয়ান। পরে অবশ্য ওয়ারেন হেস্টিংসেরও দেওয়ান হন । ওই সময়েই তিনি প্রভূত ধনম্পত্তির অধিকারী হন

আটটি মৌজায় বিস্তৃত  ছিল  তাঁর  জমিদারি। তিনি ইংরেজ ও দিল্লির নবাবের নেকনজরে  আসায়  ৪০০০ সৈন্য বাহিনী পান। ক্লাইভের সুপারিশে শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে পেয়েছিলেন  'রাজা' উপাধিও।  সেদিন রাজবাড়ির ইতিহাসে জন্ম নিয়েছিল নতুন এক ঐতিহ্যের। সে ঐতিহ্য আড়ম্বর-আভিজাত্যের। ১৭৭০ সালে  আন্দুল-রাজ রামলোচন রায় রাজবাড়িতে  প্রথম  দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন ক্লাইভের পরামর্শেই।

                     ক্লাইভের দেওয়ান তার উপর পণ্ডিত মানুষ ছিলেন রামলোচন।  তাই অনুগত 'রাজা'কে উৎসাহ দিতে প্রথমবারের সেই পুজোয় উপস্থিত হয়েছিলেন লর্ড ক্লাইভ। সঙ্গে এনেছিলেন দশ হাজার টাকার সন্দেশদেবীকে নিবেদনের জন্য ১০৮টি পদ্ম ও এক হাজার টাকা প্রণামীও এনেছিলেন সাহেব - সেদিন রাজবাড়ির ইতিহাসে জন্ম নিয়েছিল নতুন এক ঐতিহ্যের। কামানের  গর্জন, আলোর রোশনাই, কাঙালি ভোজন, নাচমহলের বেলোয়ারি ঝাড়ের টুংটাং শব্দের সঙ্গে বাইজিদের মুজরো- এই সবই  ছিল আভিজাত্যেরই স্মারক। মহাসমারোহের রাজবাড়ির শারদ-বন্দনায় একটি মহিষ, ১২টি ছাগ উৎসর্গ করা হয়েছিল সেবার।

রাজা রামলোচনের পৌত্র রাজ নারায়ণ সঙ্গীত চর্চায় সুনাম অর্জন করেন । ১৮৩৬ সালে তাকেও  লর্ড  অকল্যান্ড রাজাউপাধি দেন আন্দুল রাজবাড়ি স্থাপিত হয় ১৮৩৪ সালে, স্থাপন করেছিলেন রাজা রাজনারায়ণ রায়বাহাদুর রাজনারায়নের পুত্র বিজয় কেশবের দুই  স্ত্রী  ছিল যারা নিঃসন্তান  হওয়ায় পুত্র দত্তক নেন। যদিও প্রিভি কাউন্সিল ‘এই দত্তক বেআইনি ঘোষণা করেন। পরে পরিবারের সম্পত্তির মালিক হন ক্ষেত্র কৃষ্ণ মিত্র তিনি ছিলেন বিজয় কেশবের দৌহিত্র। এই ক্ষেত্র কৃষ্ণের বংশধরেরা আজও  আন্দুল রাজবাড়িতে বসবাস করছেন 

যদিও এখন আর সেই জৌলুস নেই। পেল্লাই এই প্রাসাদের সর্বাঙ্গে এখন জীর্ণতার ছাপ। বাড়ির সামনে কেবল মাঝের অংশে গোটা ১২ স্তম্ভ, একেকটি প্রায় ৬০ ফুট উঁচু। এটি নাচঘর। এর  ভিতরে এককালে ছিল ২০টি বাহারি স্তম্ভ। উপর থেকে ঝুলত ঝাড়বাতি। নামী বাঈজি, নর্তকীদের মজলিস লেগেই থাকত। এর দু’পাশে তিন তলা ভবনের দু’টি অংশ। প্রতিটি তল ২০ ফুট উঁচু। এখন এই তিন তলেই লোক থাকেন। নাচঘর ভেঙে চৌচির। উপরে খোলা ছাদ দিয়ে সরাসরি নীচে বৃষ্টির জল পড়ে। চারপাশে আগাছায় ভরা

কিন্তু তা বলে ঐতিহ্য রক্ষায় খামতি নেই কোথাও। রাজবাড়ির বর্তমান সদস্য অরুণাভ মিত্র জানান, সরকারি নিষেধাজ্ঞায় কামান গর্জন ও বলি বন্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুজোর রীতি পূর্ববৎই বজায় আছে । কৃষ্ণা-নবমী তিথিতে কল্পারম্ভ হওয়ার রীতি আজও চলে আসছে সমানে। সেই রীতি মেনে  অন্যান্য  পুজোর ১২দিন আগেই বসে রাজবাড়ির পুজোর আসর । রাজবাড়ির মাঠে বসে মেলা । তবে বাইজিদের সেই মুজরোর আসর আর বসে না। কিন্তু নতুন করে রাজবাড়ির সদস্যরা স্বয়ং শামিল হন ধুনুচি নাচে। অষ্টমীর দিন রাতে এই ধুনুচি নাচে এক অনন্য পরিবেশের সৃষ্টি হয় পুজোর রাজবাড়িতে। মন্দিরের আদলে এসেছে আধুনিকতার স্পর্শ - লাগানো হয়েছে আধুনিক মানের ঝাড়বাতি । এখনও রীতি মেনেই আটমণ মাটি দিয়ে তৈরি হয় একচালা প্রতিমা

                                                                                                   

                                  তবে অন্নপূর্ণা পুজো এই পরিবারের  শ্রেষ্ঠ উৎসব    রাজবাড়ির পাশেই আছে  অন্নপূর্ণা মন্দির রাজনারায়ণ রায় ১৮৪৫ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ছোট বেলায় তাঁর মা প্রায়ই বারাণসীর অন্নপূর্ণা মন্দিরে যেতেন কারণ তিনি অন্নপূর্ণার ভক্ত ছিলেন । কিন্তু বয়স্ কালে  পঙ্গু হওয়ার সাথে সাথে তিনি বার্ষিক যাত্রা  করতে  না পারায় তাঁর স্বামী  স্ত্রীর জন্য  ১৪ টি শিব

                                     মন্দিরের সাথে অন্নপূর্ণা মন্দির নির্মাণ শুরু করেন । তবে  ইতিমধ্যেই স্বামী মারা গেলে তাঁর পুত্র রাজনারায়ণ  পিতামাতার ইচ্ছা পূরণ করেন । বর্তমানে মন্দিরটি পরিচালনা করছেন  আন্দুল রাজ ডেবিটর এস্টেট   মন্দিরে পিতলের সিংহাসনে বসে আছেন প্রতিষ্ঠিত  অন্নপূর্ণা ।  পাশের শিবের মূর্তিটি অন্নপূর্ণার কাছে ভিক্ষা করে  প্রাপ্ত হওয়ায়  মূর্তিটির নাম ভিকারি শিব মূল গর্ভগৃহের দু'পাশে আরও দুটি কক্ষ রয়েছে। একটিতে বিষ্ণুর শালগ্রাম শিলা এবং একজন গোপাল। অন্যটিতে  সাতটি শিব লিঙ্গ রয়েছে যা সম্মিলিতভাবে বানেশ্বর শিব নামে পরিচিত । প্রবেশ দ্বারের মুখেই রাখা  আছে  কামান। পুজোয় প্রথম মোষবলি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কামানটি দাগা হত । সেই শব্দ পৌঁছে যেত সারা আন্দুলের ঘরে ঘরে। তারপর শুরু হত বাকি পুজোগুলি। মূল মন্দিরের দুইপাশে রয়েছে শিবমন্দির। এখনও বহু মানুষ এখানে পুজো  দিতে আসেন।

                                   সত্যজিৎ রায় জলসাঘর ছবির একটি দৃশ্য এই রাজবাড়িতে শুট করেছিলেন । এখন অবশ্য   এই রাজবাড়ি  হেরিটেজ বিল্ডিঙের সম্মান পেয়েছে। এই রাজবাড়ি ছাড়াও আন্দুলে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জায়গা রয়েছে । যেমন- ঝোড়হাট হরিসভা গৃহ, শঙ্করী মন্দির, কুণ্ডু চৌধুরী বাড়ি, পঞ্চানন্দ মন্দির, সাধক ভৈরবীর গুহা ইত্যাদি। আন্দুল এই নামটি কেন, তা নিয়ে নানান মতামত রয়েছে। সেই রহস্য  ভেদে একবার   যেতেই  পারেন এই বাড়িতে । শীতের আমেজে পলাশীর  লুন্ঠন  ও নবাবের স্মৃতি উস্কে নিতে খানিক মন্দ লাগবে না ।                                

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...