ভারতের মধ্যেই আছে এক মিনি পোল্যান্ড

           ‘যখন রাশিয়া ছেড়েছিলাম তখন আমার বয়স ৪। পোল্যান্ডের স্মৃতি যতটুকু মনে রয়ে গিয়েছে তা খুবই সামান্য। সে স্মৃতি বড় দগদগে। নিজের মাটি, সদ্য চিনতে শুরু করা ঘর, পরিজন ছেড়ে সম্পূর্ণ অন্য একটা দেশে চলে আসা। আমার কাছে শৈশবের স্মৃতি বললে ভারতের কথাই মনে হয়। যে দেশ আমাদের মত ঘরছাড়া দের দ্বিতীয়বার বাঁচার সুযোগ দিয়েছিল। আশ্রয় দিয়েছিল।’

 

কথাগুলো পোল্যান্ড থেকে ভারতে আসা এক ঘরছাড়া মানুষের। ল্যঙ্ককুকা লাবুস নামের এক পোলিশ মহিলার। খাতায় কলমে যার নামের আগে ‘রিফিউজি’ শব্দটা পাকাপাকিভাবে বসে গিয়েছে।

  ক্লারা বানাসিনস্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেড ক্রসের কর্মী হিসেবে কাজ করতেন, দূতাবাস কর্মীর দায়িত্বেও ছিলেন। ইরান থেকে ২ হাজার কিলোমিটার দূরে এখানের ক্যাম্পে নিয়মিত খাবার এবং ওষুধ পাঠাতেন।

সাইবেরিয়ার লেবার ক্যাম্প থেকে হাজার হাজার দুঃস্থ, রুগ্ন, অসহায় পোলিশ রিফিউজি সোভিয়েত ইউনিয়নে আশ্রয় নিতে থাকে। বেশিরভাগই পালিয়ে আসে।

সেখানে তাদের অসহায় অবস্থা দেখে ক্লারা তাদের সাপ্লাই ট্র্যাকে করে ভারতে পাঠানোর পরিকল্পনা করলেন। ভারত সরকারের সঙ্গে প্রয়োজনীয় চুক্তি এবং আলোচনা সারার পর ঠিক হল এই সব অসহায় গৃহহীন, দেশছাড়া মানুষগুলোকে প্রাথমিকভাবে গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রে ঠাঁই দেওয়া হবে।

সেই থেকে তাঁরা এখানেই। যুদ্ধ থেমেছে। পরিবেশ বদলেছে। বদলেছে বৈদেশিক পরিস্থিতিও। কিন্তু যুদ্ধ, অস্থিরতা, কাঁটাতার পেরিয়ে এদেশে এসেছিল যে মানুষগুলো তারা রাশিয়া নয়, ভারতকেই আপন করে নিয়েছে এত বছর ধরে।

মহারাষ্ট্রের ভালিভেদা গ্রাম। কোলহাপুর থেকে ৮ কিমি দূরে। স্থানীয় লোকজনের কাছে এই গ্রামের পরিচিতি পোলিশদের গ্রাম নামে। বেশির ভাগই শিশু এবং মহিলা। সরকারিভাবে যাদের সংখ্যাটা ৬৪০। শিশুরা অনেকেই যুদ্ধে অভিভাবকহীন।   

অবশ্য ব্রিটিশ সরকার বাধা দিয়েছিল। মুম্বই বন্দরে জাহাজ ভিড়তেই আটকে দেওয়া হয় তাদের। সেই সময় মহারাজা দিগ্বিজয় রণজিৎ সিং জাদেজা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ইংরেজেদের বিরোধীতাকে এড়িয়ে সরকারকে রাজী করান। তবে নিজের শাসনাধীন রোজি বন্দরে।

FotoJet (5)

 

১৯৪৩-১৯৪৮ প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ পোল্যান্ড থেকে ভারতে আসে।  ‘রিফিউজি’ পরিচয়েই তারা ভারতের এই অংশে বসবাস করতে শুরু করে। পাঁচ গঙ্গা নদীর তীরে। স্কুল, হসপিটাল, পোস্ট অফিস, ফায়ার ব্রিগেড, সব মিলিয়ে পাঁচ বছরের মধ্যেই ভালিভেদা মিনি পোল্যান্ড হয়ে ওঠে।

নিজেদের দেশের অস্থিরতা এবং  ভয়ের দিন পেরিয়ে যেন নিশ্চিন্ত জীবনের সন্ধান পায় তারা। সরকারী ভাবেই তাদের দু কামরার কোয়ার্টার তৈরি করে দেওয়া হয়। একটি বাজারও তৈরি হয় নিত্য প্রয়োজনের জন্য। বাজারে পণ্যের দাম সবটাই ‘ফিক্সড প্রাইস’এ ধার্য।

FotoJet (3)

পরবর্তী সময়ে অনেক বাসিন্দাই কর্ম সংস্থানের জন্য বিদেশ চলে গিয়েছে। আবার অনেকেই ভারতীয় নাগরিকদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এদেশের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন পাকাপাকিভাবে। বিদেশি নাম বদলে নিয়েছেন নতুন ভারতীয় নামে। ‘নইক্কা’ হয়েছেন ‘মালতী’।

ঊষা কাশেকর এমনই এক পোলিশ ভারতীয় মহিলা। তাঁর কথায়, ‘ এখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন এখানকার বাসিন্দারা। কিন্তু তাঁরা বেশিরভাগই বছরে একবার হলেও এখানে আসেন। নিজেদের বাড়ি বলতে এখনও তাঁরা ভালিভেদাকেই বোঝেন। সেকেন্ড হোমল্যান্ড। আমাদের জীবনের সেরাদিনগুলো আমরা এখানেই কাটিয়েছি।’   

 

          

                                             

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...