হুজুগে, উৎসব প্রিয় বাঙালি সারা বছর কোনো না কোনো উৎসবে মেতে থাকলেও তাঁর প্রাণের উৎসব কিন্তু দূর্গাপুজো। এখন নানা থিমের পুজো শুরু হলেও, শহরের বনেদি বাড়িগুলোর পুজোর ঐতিহ্য কিন্তু এখনো অক্ষুন্ন রয়েছে। আর সেই তালিকার এক্কেবারে প্রথম সারিতে আছে উত্তর কলকাতার বিখ্যাত এমন এক পুজো, যেখানে প্রতি বছর পুজো দেখার জন্য ভিড় উপচে পড়ে। কিন্তু জানেন কি পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের বিজয় উৎসব ছিল এই রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। আজ সেই তথ্য দেব।
বলছি শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর কথা। এই ঐতিহাসিক ঘটনার মূল চরিত্র শোভাবাজার রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব। প্রায় কপর্দকহীন, পিতৃহীন অবস্থা থেকে এক সফল জমিদার হওয়া মুখের কথা নয়। প্রথম জীবনে প্রায় শূন্য অবস্থায় কলকাতার কাছে গোবিন্দপুরে এসে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু প্রখর বুদ্ধি ও উদ্যমে নিজের চেষ্টায় আয়ত্ত করেন উর্দু, আরবি, ফার্সি। নিজের যোগ্যতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামান্য মুনশী হিসেবে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। ইতিমধ্যেই তার ভাষা শিক্ষা তাকে ওয়ারেন হেস্টিংসের নেক নজরে নিয়ে আসে। সরকারি কাজকর্মের পাশাপাশি শুরু করেন ওয়ারেন হেস্টিংসকে ফার্সি ভাষা শেখানোর কাজ।
এবার বলি তার সাথে পলাশীর সংযোগ ঠিক কোথায়! পলাশীর যুদ্ধের ফল স্বরূপ মীরজাফর বাংলার মসনদে বসলে লাভবান হলেন রাজাকৃষ্ণ চন্দ্র এবং নবকৃষ্ণ দেব। মীরজাফরের সঙ্গে সিরাজের গোপন কোষাগারের বিপুল ধনসম্পত্তি ভাগাভাগি করে নেন নিজেদের মধ্যে। আর ওই সম্পদের জেরেই নবকৃষ্ণ বিশাল ধনদৌলতের মালিক হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার সাথে আসে সম্মানও, নবকৃষ্ণের ক্ষেত্রেও এলো তাই। নির্মাণ করলেন রাজবাড়ি।
পলাশীর যুদ্ধ শেষে লর্ড ক্লাইভ নবকৃষ্ণ দেবকে পলাশীর যুদ্ধ জয় উপলক্ষে কলকাতায় একটি বিজয় উৎসব করার পরামর্শ দেন। নবকৃষ্ণ ঠিক করলেন, দেবী দুর্গার আরাধনা করেই শুরু করবেন বিজয় উৎসব। এই রাজবাড়ির পুজো ছিল পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের বিজয় উৎসব। বসন্তকালের দুর্গাপূজাকে নিয়ে এলেন শরৎকালে। ১৭৫৭সালে নিজের নব নির্মিত ঠাকুর দালানে শুরু করলেন অকাল বোধন। শুরু হল কলকাতার দুর্গাপূজা। তাতে একশো এক টাকা দক্ষিণাও পাঠিয়েছিলেন ক্লাইভ! বিশাল আয়োজন করে শুরু হল শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো। যা শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মিশেল। কিছুদিনের মধ্যে ইংরেজদের তাঁবেদারির পুরস্কার স্বরূপ পেলেন ‘রাজাবাহাদুর’ খেতাব; তার কিছুদিনের মধ্যেই ১৭৬৬সালে পেলেন ‘মহারাজা বাহাদুর’। সর্বোপরি গোটা সুতানুটি অঞ্চলের তালুকদার হয়ে ওঠেন তিনি। যদিও গ্রামীণ কলকাতার প্রথম পুজোর দাবিদার কিন্তু সেই বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীরাই। তবে শহুরে কলকাতার প্রথম পুজোর সূচনা এই নবকৃষ্ণের হাত ধরেই। যার ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেহাত কম নয়।