‘আবর্জনা থেকে উদ্ধার সদ্যজাত শিশুকন্যা, ‘কন্যা সন্তান হওয়ায় বাবার হাতে মৃত্যু’, ‘শৌচাগারে মিলল নবজাতিকার দেহ’ সংবাদ পত্রে এমন হেডলাইনে এখন আর কেউ বিশেষ চমকায় না। এই সব শিশুদের অপরাধ একটাই তাদের জন্ম কন্যা হিসেবে, তার জেরেই জন্মের পর প্রিয়জনদের হাতে তাদের এমন পরিনতি।
পুত্রসন্তানের জন্মে ঢাক ঢোল মিষ্টি বিতরণ, কন্যা হলে রাগ, বিরক্তি। ছাড় পায় না শিশুকন্যার মা-ও। এমন ঘটনাও দেখা গিয়েছে কন্যা সন্তান ‘হওয়ার’ অপরাধে প্রসূতিকে হাসপাতালে ফেলে চলে গিয়েছে স্বামী এবং আত্মীয়রা। গর্ভ সঞ্চার হওয়ার পর থেকেই প্রবল চাপ থাকে। দাবী চাহিদা একটাই- ‘চাই পুত্রসন্তান’। পরিবারের আর্থিক বা সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, তাতে ছবিটা বিশেষ বদলায় না।
এই যখন পরিস্থিতি তখন এক অন্য আশার আলো দেখাচ্ছেন বারাণসীর চিকিৎসক ডাঃ শিপ্রা ধর শ্রীবাস্তব। বারানসীর ফাড়িয়া অঞ্চলে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান আছে তাঁর। কন্যা সন্তানের জন্মে প্রসূতি পরিবারের কাছ থেকে কোনওরকম পারিশ্রমিক নেন না। সম্পূর্ণ বিনাব্যয়ে প্রসূতি মায়ের চিকিৎসা করেন এই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ।
কন্যা সন্তানের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীর বদল আনতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি মেডিকেল কলেজের প্রাক্তনী ডাঃ শিপ্রা ধর শ্রীবাস্তব বলেন, কন্যা সন্তানের জন্মের পর বাবা-মা পরিবারের হাসিমুখ তাঁর সেরা প্রাপ্তি। তাঁর নিজের কথায়, ‘মেয়ে মানেই ‘না’’ এমন বহু ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। গর্ভস্থ ভ্রুণটি কন্যা জেনে তাকে নষ্ট করার প্রস্তাবও শুনতে হয়েছে প্রসূতির পরিবার থেকে, এমন নজির অনেক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবার বা আত্মীয়ের ভয় কাজ করে। মেয়ে হয়েছে শুনেই মুখে অন্ধকার নেমে এসেছে। নতুন শিশুর আগমনে যেন কোনও আনন্দ নেই তাদের!উচ্ছ্বাস নেই! শুকনো মুখ! দেখে কে বলবে সবেমাত্র পরিবারে এক নতুন অতিথি এসেছে!
নর্ম্যাল ডেলিভারির থেকে সিজারিয়ান ডেলিভারিতে যখন কন্যাসন্তান হয় তখন আত্মীয়দের ‘দুঃখ’ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়, কারণ তাতে ব্যয় বেশি। এই ছবিটাই বদলাতে চেয়েছেন তিনি।
অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়েছেন। এখনও পর্যন্ত একশোর বেশি শিশুকন্যার জন্ম হয়েছে ডাঃ শিপ্রা ধর শ্রীবাস্তবের হাতে। হাসপাতালের বেড থেকে চিকিৎসা কিংবা অস্ত্রপ্রচার তাদের সবটাই হয়েছে বিনাব্যয়ে।
বিশিষ্ট এই চিকিৎসকের কথায়, তিনি শুধু মানুষকে বোঝাতে চেয়েছেন পুত্র হোক বা কন্যা একটি শিশুর সুস্থভাবে পৃথিবীতে আগমনই আসল বিষয়, অন্য কিছু নয়। পুত্র এবং কন্যা দুই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ডাঃ শিপ্রা ধর শ্রীবাস্তবের স্বামী মনোজ কুমার শ্রীবাস্তবও পেশায় চিকিৎসক। তিনিই তাঁকে শিশুকন্যার জন্মে বিনা পারিশ্রমিকের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁদের ভাবনায় চমকে গিয়েছিল আত্মীয় বন্ধুরা। তারা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বিনিময়ে তাঁরা কী পাবেন?’। চিকিৎসক দম্পত্তির উত্তর ছিল ‘শিশুকন্যা’।
আর্থিক দুশ্চিন্তা কখনও তাঁদের সিদ্ধান্তের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। লড়িয়া করতে হয়েছে, কিন্তু হেরে যাননি। চিকিৎসকমহল, ওষুধ সরবরাহকারী সংস্থা এবং বহু মানুষকে পাশে পেয়েছেন। এসবের পাশাপাশি দরিদ্র শিশুকন্যাদের পড়ার খরচেও সাহায্য করেন তিনি। অনেককেই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পৌঁছে দিতে পেরেছেন।
ডাঃ শিপ্রা নিজে পুত্র ও কন্যা সন্তানের মা। ছেলেমেয়ের মধ্যেও চেষ্টা করেন মানুষকে ভালোবাসার বীজ রোপন করতে। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছিলেন। অনেক ঝড় ঝাপটা সামলে তাঁর চিকিৎসক হয়ে ওঠা। তাই যেন জীবনে ছায়াগাছ হয়ে ওঠা কতটা দরকার তা মর্মে মর্মে অনুভব করতে পেরেছেন তিনি। তাঁর নিজের জীবনেও বিশ্বাস করেন মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালবাসাই ভালো থাকার আসল পথ...