তখনও টালিগঞ্জপাড়াটা ‘টলিউড’ হয়ে ওঠেনি। ঝাঁ চকচকে চাকচিক্যের অন্তরালে আটপৌরে বাঙালি জীবন ফল্গু ধারায় বইছে। ঠিক সেই সময়ে বাংলা সিনেমার জগতে পা রাখলেন তিনি। অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়।
স্বাধীনতা-উত্তর পরিস্থিতি। স্বপ্নভঙ্গের নিরাশা। সমাজের গভীরে প্রছন্ন বিপ্পন্নতা। এক ধাক্কায় রাতারাতি বদলে যাওয়া দেশের আর্থ-সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট গভীরভাবে ছাপ ফেলেছিল চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও। ক্ষ্যাপা সময়ের তাতে মন পুড়ে খাঁক। অস্থির সময়ের টানাপোড়েন এড়িয়ে শ্যাম-স্নিগ্ধতার ছায়া।যেন কোনও অনিবার্যতার সূত্র ধরেই তাঁর চলচ্চিত্র প্রবেশ ঘটল।
বাঙালির তেল চিটচিটে, ঘোলাটে যাপনে প্রেমহীনতার যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল রোগা-ঢ্যাঙা- আপাত মলিন এক ‘ডক’ কর্মচারী শুশ্রূষার প্রলেপ ফেললেন তাতে। প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারে শাপমোচন ঘটালেন।
অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে লাগলেন গণদেবতার ‘উত্তমকুমার’। কোনও বিদ্রোহ নয়, কোনও বিপ্লব নয়, কোনও স্লোগান বা আন্দোলন নয়, মধ্যবিত্ত কেরানি জীবনে প্রেমকে ফিরিয়ে দিলেন তিনি। পর্দার প্রেম হৃদয়ের দাবি নিয়ে ধরা দিল জনতার মনে।
শুধু প্রেম নয়, মধ্যবিত্ত বাঙালির পারিবারিক মূল্যবোধকেও হাতিয়ার করেছিলেন অরুণ ‘চ্যাটার্জি’। শুরুর পথটা অবশ্য সুগম ছিল না। ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ থেকে ‘উত্তমকুমার’ হয়ে ওঠার পথে অজস্র কাঁটার আঘাত। বেদনার ক্ষত।
‘বসু পরিবারে’র জনপ্রিয়তার পর থেকে ভাগ্যের চাকাটা ঘুরতে শুরু করল। তারপর ‘অগ্নিপরীক্ষা’। সেখান থেকেই মেরুদন্ডে প্রবল জোর নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল একটা যুগ। ইন্টালেকচুয়ালিটির ঝাঁঝ নয়, আটপৌরে ঘরোয়া স্নিগ্ধতা, আর তার চিরকালীন আবেদনের যাদু। ঠোঁটটা হাল্কা ফাঁক খুলে ঘাড় ফিরানো হাসি আর ম্যানারিজম। এছাড়া আলাদা কোনও সৌন্দর্য মানে কাটাকাটা, টানটান হলিউডি হিরোর মত ‘লুক’ তাঁর ছিল না। অদ্ভুত একটা ইনোসেন্ট আমেজ ছিল যার টান দর্শকরা এড়াতে পারেনি কোনওভাবেই।
বন্ধু, প্রেমিক, দাদা কিংবা পুত্র সবেতেই আদর্শ। স্টারডামের কেতা গলে অনায়াসে হয়ে উঠতে পেরেছিলেন অজস্র মেয়ের একলা দুপুরের সঙ্গী। সেলুলয়েড থেকে বেরিয়ে একদম আস্ত একটা ‘ নিজের মানুষ’। যাকে দেখা যায়। শোনা যায়। অনুভব করা যায়। শুধু ছোঁয়া যায় না।
সযত্নে গড়ে তোলা ক্যাজুয়াল ইমেজ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই মোহগ্রস্থ তাতে। সত্তরের পোড়া রুটির মত চাঁদ ঘুম-ঘুম চোখ মেলে নতুন করে হেসে নিজের চরিত্রের বদল ঘটালো। সাদা-কালো পর্দা সবুজ ঘাসে ঢাকা গাছের তলায় কৃষেন্দু-রিনা ব্রাউনের প্রেমের সংলাপ অজস্র মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্যবিত্ত বাঙালি অন্দর মহলে। বাইকের চাকার চিরন্তন গতিরেখায় এই পথ শেষ না হওয়ার আবেদন। আর যেটুকু ডুবতে বাকি ছিল সেটুকুও আর বাকি থাকতে দিল না মায়াবি হাসি, ফিরু চোখের দৃষ্টি আর হাওয়ায় উড়ন্ত টাইয়ের ফিতে। বাঙালি প্রেমিকের শিরায় শিরায় বাইকের গতি মিশে গেল।
শহরের ইট-কাঠ- পাথর-গলি-রাজপথ প্রেমের দাগে রাঙা। এমনকি পাশের বাড়ির মেয়েটা আর ছেলেটাও। খুব তাড়াতাড়ি তারাও যেন বদলে যেত থাকল সিনেমার মত। ‘সামাজিক রীতিনীতি’ বা যৌথ পরিবারের দায়বদ্ধতায় থেকেও কোনওভাবেই মনের ভিতর চুইয়ে পড়া প্রেমটাকে মরতে দেয়নি বাঙালি। আর তাই প্রতিটি প্রেমিকার নীরব চোখের ভাষায় প্রেমিক পুরুষটি একটি কথাই পড়তে পেরেছিল, ‘প্রেমিক যদি হও তো, উত্তম কুমারের মতো হও।’
‘বসন্ত বিলাপ’ সিনেমায় অভিনেতা চিন্ময় রায়কে তাঁর প্রেমিকাকে বলেছিলেন, ‘একবার উত্তমকুমার বলো’- সে কথারই স্বাক্ষর রেখে গিয়েছে।
উত্তমকুমার অভিনীত সমস্ত সিনেমা, সব চরিত্রের মধ্যে ভয়াবহ ভাবে প্রেম খুঁজতে চেয়েছে মানুষ। সে প্রেমিক কখনও হেরে যেতে পারে না। কোনও প্রতিকূলতা তাকে থামিয়ে দিতে পারে না। প্রেমিকার প্রতি অভিমানে সে দূরে যেতে পারে, হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু শেষ দৃশ্যে তাকে ফিরে আসতেই হবে। তার ফিরে আসা শুধু প্রেমিকার কাছে নয়, দর্শকদের কাছে। পর্দার প্রেমিক উত্তম যত না প্রেমিকার, তার চেয়ে অনেক বেশি দর্শকদের। অসহনীয় বিরহ। তাতে মহিলা-পুরুষ উভয়েই পুড়ে ছারখার।
ভার্সেটাইলিটির তাগিদে উত্তম রোম্যান্টিক নায়কের ইমেজ ভেঙে ভিলেন বা ক্যারেক্টার রোলে অভিনয়ের দিকে ঝুঁকলেন। দেখা গেল ভিলেনের ভুমিকাতেও। কিন্তু দর্শক প্রতিটি দৃশ্যে হারানো প্রেমিককেই খুঁজে ফিরছে যে। মানতে হয়েছিল তাঁকেও। ভিলেনের খোলস ত্যাগ করে আবার সেই আগের মতো। দর্শকের ‘গুরু’। বাংলার ম্যাটিনি আইডল।
তাঁর মৃত্যুর ৩৯ বছর পরে প্রশ্ন জাগে আমূল বদলে যাওয়া সময়ে, শিকড় হারাতে বসা একটা জাতির কাছে উত্তমকুমাররে সেই স্নিগ্ধতা আদৌ কী ছায়া ফেলে। নাকি সবটাই ফেলে আসা সময় আর ভুলে যাওয়া সংস্কৃতির বাতিল বাকল? এক সময়ের অমোঘ সেই মানুষটি কী এখনও আছেন?
উত্তরগুলো অজস্র উপায়ে আমাদের চারপাশেই ঘুরপাক খায়।
ফাঁকা ফ্ল্যাটের নিঃসঙ্গ দুপুর কিংবা সন্ধেতে স্মার্ট টিভির জায়ান্ট স্ক্রিনে নিবদ্ধ কোনও বৃদ্ধের ছাপসা দৃষ্টি। কাঁপা হাতের রিমোট। চ্যানেলে-চ্যানেলে খোঁজে সাদাকালো সময়। আর সেই বৃদ্ধাশ্রমে জানলার ধারে সন্তান পরিতক্ত্যা একাকী বৃদ্ধা ফেলে আসা কিশোরী হৃদয়ের গল্পে। তিনি আছেন। কখনও ‘কৃষ্ণেন্দু’ কখনও ‘উত্তম’ হয়ে। কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে। কোনও ব্যর্থ প্রেমিক বা ঘা খাওয়া প্রেমিকা লিখে রেখে যায়-
আই উইল গো টু দ্য টপ, টপ অ্যান্ড টপ...
শুধু ভারচুয়ালিটির দোহাইতে টেবিল চাপড়ানোর রাগী শব্দটুকু অধরা থেকে যায় একান্তে।