অধিকাংশ বাঙালি সাহিত্যিকেরই কিন্তু লেখালেখির শুরুটা হয়েছে কবিতা দিয়ে। লাভপুরের তারাশঙ্করেরও তাই। তখন তাঁর বয়স কত আর হবে, এই ধরুন, সাত পেরিয়ে আট। পড়ন্ত হলেও তিনি জমিদার বাড়ির ছেলে। ফলে, ন্যাওটা স্যাঙাতের অভাব ছিল না। তবে তাদের মধ্যে বিশেষ ছিল দু'জন। পাঁচু আর দ্বিজু। পাড়ার সঙ্গী, পড়ার সঙ্গী, খেলার সঙ্গী, এমনকি দস্যিপনারও সঙ্গী তারা।
সেদিন বাড়ির বাগানে তিন বন্ধু মিলে মেতেছেন খেলায়। খেলা মানে, বাগান দাপিয়ে এন্তার লাফঝাঁপ এবং থেকে থেকে হাঁপিয়েহুঁপিয়ে হাসি আর চিৎকার। খেলাটা সবে জমে উঠেছে, এমন সময় হঠাৎ থমকে যেতে হল, থেমে যেতে হল তিন জনকেই। থামিয়ে দিল ছোট্ট একটা পাখির ছানা। ছানা তো না, যেন একটা তুলতুলে মাংসের লালচে দলা। ডানার পালক গজায়নি, চোখ ফোটেনি, মুখ ফুটেছে শুধু। তাই গাছের ডালের বাসা থেকে এই একলা ছানাটি যখন তাঁদের সামনে ধুপ করে পড়ল, তখন তীব্র চিঁ চিঁ চিৎকারে কেঁদে উঠল সে। আর তাতেই তিন বন্ধুর দস্যিপনা থেমে গেল। ছানাটার করুণ কান্না শুনে বড্ড মায়া হল মনে। আহারে, এমনি করে পড়ে থাকলে তো লাল পিঁপড়ের দল এক্ষুনি এসে ঘিরে ধরে জ্বালিয়ে মারবে--তখন ওদের অত্যাচারে নির্ঘাত মরে যাবে বেচারা! না না, তিন তিনজন থাকতে ছানাটাকে কিছুতেই মরতে দেওয়া যাবে না। তারাশঙ্করের মনে হল, আহা, বেচারা বাসা হারিয়ে ফেলেছে, বাপমাভাইবোনদের হারিয়ে ফেলেছে; ওকে একা একা কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া যাবে না। আর ছেড়ে দিলে যাবেই বা কোথায়? ও কী উড়তে পারে, নাকি দেখতে পায়! তার চেয়ে নিজের কাছেই রাখতে হবে যতদিন না মানুষ হয়। তখন নিজেই নিজের বাসা খুঁজে পায় ভালো, নয়তো পোষ মেনে বাড়িতেই থাকবে। বাড়িতে থাকলেই ভালো, খুব মজা হবে! শিশুমনের এই সাদর সিদ্ধান্তে তিনমূর্তির একমত হতে এক মুহূর্তও লাগল না।
ছানাটা গাছ থেকে পড়েছে, মানে, তার বড়রকম একখানা দুর্ঘটনাই হয়েছে। সুতরাং, প্রথমে তাকে মাটি থেকে তুলে বেশ ভালো করে সেবা-শুশ্রূষা করতে হবে। তারপর তাকে ঘরে নিয়ে যাওয়া হবে। বেশ। যেমন ভাবা তেমন কাজ। শুরু হয়ে গেল শুশ্রূষা। কিন্তু, আবেগের বশে তাল রাখা গেল না, শুশ্রূষাটা একটু বেশিই হয়ে গেল। আর তারই চোটে বেচারা ছানাটা দুম করে মরে গেল। কিন্তু, সরল শিশুমন ভাবল--ইস, হায় রে হায়, এ কী হল! এত চেষ্টার পরও মরে গেল! মনে খুব কষ্ট হতে লাগল--এই যে তাকে মানুষ করার কত স্বপ্ন দেখা হল, এতক্ষণ শুশ্রূষা করা হল, তাতে বুকের ভেতরে তার জন্য বড্ড মায়া জমে উঠেছিল। আর তাই-ই যেন অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে চাইল। তিনজনই মাথা নিচু করে বসে। কারো মুখে কোন কথা নেই। শুধু স্থির চোখের সামনে পাঁচু তার ডান হাতের তালু প্রসারিত করে রেখেছে। সেখানে শুয়ে আছে ছানাটি। নিথর।
হঠাৎ তিন বন্ধুর মাথার ওপরে গোল গোল চক্কর কাটতে লাগল একটা পাখি। তিন বন্ধু চোখ মেললেন আকাশে। নিশ্চয় মা পাখি। উড়তে উড়তে অবিরাম ডাকছে। হয়তো বা ডাকছে না, ছানাটি বেঁচে নেই বুঝে কাঁদছে! ভীষণ করুণ তার কান্না। হয়তো সেই কান্না লুকোতেই মা খানিক পরে চলে গেল। কিন্তু, তিন বন্ধু আর কান্না লুকোতে পারলেন না। এবার কেঁদে ফেললেন।
শিশুরা আবেগ ভরে যেমন কাঁদতে জানে, তেমনি নিজের চোখের জল মুছতেও জানে। তারাশঙ্করও খানিক কেঁদে চোখ মুছলেন। বললেন যে, পোষা পশুপাখিদের হয় জলে, নয় মাটিতে সমাধি দেয়--তিনি দেখেছেন। ছানাটিকে তিনি তো পুষতেই চেয়েছিলেন। তাই সমাধিই দিতে হবে তাকে, মাটিতে।
পাখির ছানাটি সমাধিস্থ হল। বাগানেই। তিন বন্ধুরই বুকে শোক। তিনজনই চুপ। কিন্তু, পাঁচু আর চুপ করে থাকতে পারল না। তার শোক বাল্মীকির ক্রৌঞ্চমিথুনের শোকের মতোই শ্লোক হয়ে প্রকাশিত হল--
'তারাদাদার পাখীর ছানা মরিয়াছে আজি
তার মা এসে কাঁদিতেছে কেঁউ কেঁউ করি।'
দ্বিজুর কবিতা আসে না, সে-ই শুধু প্রকৃতপক্ষে চুপ হয়ে ছিল। কিন্তু, তারাশঙ্করের শোকসন্তপ্ত মনেও কাব্য এসে নাড়া দিল, আর পাঁচুর কবিতা তাতেই ইন্ধন জোগাল। তিনি একটা খড়ি নিয়ে লিখতে শুরু করলেন খিড়কির দরজায়---
'পাখীর ছানা মরে গিয়েছে
মা ডেকে ফিরে গিয়েছে
মাটির তলায় দিলাম সমাধি
আমরাও সবাই মিলিয়া কাঁদি।'
খাতায়-কলমে নয়, এভাবেই ভাবি সাহিত্যিক তারাশঙ্করের সাহিত্যসাধনার সূত্রপাত হয়েছিল--দরজার গায়ে, খড়ির আঁকে। দরজার ফলকে সেই কবিতা এমনি করেই তাঁর হাতের লেখায় শিলালিপির মতো জ্বলজ্বল করে বেঁচে ছিল আরও আঠারো বছর।
বয়সের একটা মহৎ দোষ হল, ছেলেমানুষি সে দু'চোখে দেখতে পারে না। রোখ চাপলেই ছেলেমানুষির সমস্ত নমুনা মুছে ফেলার কালাপাহাড় হয়ে ওঠে সে। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সে তারাশঙ্করের মধ্যে সেই কালাপাহাড়সত্তা জেগে উঠল। একদিন সাদা রঙ এনে সেই দরজায় যেই নিজের হাতে রঙ করে দিলেন; অমনি তাঁর সেই কচিহাতের অক্ষরমালা, নেহাত স্মৃতি হয়ে গেল!