থিয়েটার ফর্মেশন পরিবর্তক প্রযোজনার হাত ধরে পুনরায় মঞ্চস্থ হতে চলেছে উৎপল দত্তের ‘তিতুমীর’। ২১শে অগাস্ট, বুধবার, সন্ধ্যে ৬.৩০ এ আকাদেমী অফ ফাইন আর্টসের মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে এই নাটক, জোরকদমে চলছে তারই মহড়া।
নাটকটির নির্দেশনায় রয়েছেন জয়রাজ ভট্টাচার্য। চন্দন সেন, অনির্বাণ ভট্টাচার্যের পাশাপাশি প্রখ্যাত অভিনেতা অসিত বসুও অভিনয় করছেন নাটকটিতে। তিতুমীরের চরিত্রে দেখা যাবে অনির্বাণ ভট্টাচার্য্যকে।
এর আগে সুমন মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘রাজা লিয়ার’ নাটকে জয়রাজের সঙ্গে সহ অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছেন অনির্বাণ, তবে জয়রাজের নির্দেশনায় প্রসেনিয়ামে এই প্রথম।
অন্য থিয়েটার দলগুলির থেকে কোথায় আলাদা এই দল?
প্রসেনিয়াম থিয়েটার করতে গেলে স্বভাবতই একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হয়। তবে তার দোহাই দিয়ে কর্পোরেট ফান্ড সংগ্রহ করে না এই দল, বরং তার বিরোধিতা করে। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে খবরের কাগজে সারিবদ্ধ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শোভা বাড়ানো তথা দর্শক টানারও কোনও অতিরঞ্জক বালাই নেই এদের। নাটকের পোস্টারে, ব্যানারে অথবা টিকিটে বিরাট আকারে নির্দেশকের নাম ছাপানোর দীর্ঘকালের রীতিও এখানে অনুপস্থিত। আর আরও আশ্চর্যের বিষয়, টিকিটের কোনো নির্ধারিত মূল্য নেই। এই সিদ্ধান্তের পিছনে যে সূক্ষ্মতম কারণটি নিহিত আছে তা হল, টিকিটের নির্ধারিত মূল্য বেঁধে দেওয়ার ফলে দর্শকবৃন্দকে একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়, ফলত অবধারিতভাবেই সেখানে চলে আসে শ্রেণীবৈষম্যের বিষয়। নাটকটি স্বয়ং কোন শ্রেণীর দর্শক প্রত্যাশা করছে, তা ঠিক করে দেয় নির্ধারিত টিকিটের মূল্য, ফলে বহু শিল্পপ্রেমী তথা থিয়েটারপ্রেমী মানুষ তা থেকে বঞ্চিত হন। আর ঠিক এই ধরণের দর্শকদেরই আহ্বান জানায় থিয়েটার ফর্মেশন পরিবর্তক, যারা দর্শকাসনে উপস্থিত থেকে সক্রিয়ভাবে নাটকটির অংশ হয়ে উঠতে চান, কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের বিনিময়ে টিকিট সংগ্রহ করতে না পারায় অনেকক্ষেত্রেই তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। টিকিটের মূল্য নির্ধারিত না করার ব্যাপারটি গত পাঁচ বছর ধরে সুনিশ্চিত করে আসছেন জয়রাজ, সে ক্ষেত্রে মানুষের সততার উপরই বিশ্বাস রেখেছেন তিনি, তিতুমীরের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। অনলাইন বুকিং ও ফোন বুকিং এর সুবিধে না থাকা সত্ত্বেও, তিতুমীর মঞ্চে প্রবেশ করার সাত দিন আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে সমস্ত টিকিট।
ব্রিটিশ আমলে জমিদারী প্রথা-ব্যবস্থার করাল থাবার আড়ালে কৃষিজীবি-শ্রমজীবিদের মতো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রাণ যখন প্রায় ওষ্ঠাগত, তখন সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিতুমীর। প্রথম জীবনে ছিলেন এক জমিদার পরিবারের পেয়াদা, সেখানে জমিদারের হয়ে লেঠেলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হত তাঁকে। পরে, তাদেরই বিরূদ্ধে হাতিয়ার হয়ে গর্জে ওঠে বাংলার বাঁশের তৈরী এই লাঠি। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে প্রায় ১৫০০০ লেঠেল নিয়ে জমিদার রাজ ও তার দোসর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরূদ্ধে লড়ে গিয়েছেন দ্বিধাহীন লড়াই। বারাসাতের নারকেলবেড়িয়ায় নির্মিত বাঁশের কেল্লা হয়ে উঠেছিল তাদের প্রধান ঘাঁটি।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক এই নাটক। তিতুমীরের লাঠি যে এখনও সম্পূর্ণ হেলে পড়েনি, তারই আগাম বার্তা দিতে চলেছে এই নাটক। এ নাটক তিতুমীরের আভ্যন্তরীন রাজনীতিকেই শুধু মঞ্চে তুলে ধরবে না, তার পাশাপাশি যে কোনো প্রকার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সমঝোতাহীন অবস্থান গ্রহণ করার নীতি এখনও যে মানুষের বিবেকে প্রবলভাবে জাগ্রত, তার মহান আদর্শকে পাথেয় করে, নতশিরে তা থেকে অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করে এখনও যে দিকে দিকে বহু মানুষ লড়ে যাচ্ছেন তাদের লড়াই, বুধবার, আকাদেমীর মঞ্চে সেই বার্তাই দর্শকদের পৌঁছে দিতে চলেছে ‘তিতুমীর’।